চাই একে অপরের সেতুবন্ধন ও সংযোগ

ঝর্না বড়ুয়া | সোমবার , ৫ জুলাই, ২০২১ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর আবহমান কাল থেকে মানুষ জীবনের প্রয়োজনে আত্মীয় পরিজন নিয়ে বসবাস করে আসছে। প্রথমত পশুপাখি জীবজন্তু থেকে নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য পরিবার পরিজন সম্পদকে নিয়ে একসঙ্গে বসবাসের কালসীমা শুরু হয়। মানুষের ভাব আদান-প্রদান, সুখ-দুঃখ, রক্তের স্রোতধারা বিভিন্ন কিছু চিন্তা করে আমাদের মাঝে আত্মীয় পরিজনদের সাথে সেতুবন্ধনগুলো রচনা হয়। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, আমরা এতো বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি, আমাদের পরিজনদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আন্তরিক সেতুবন্ধন গুলো রক্ষা করছি না। যেখানে স্বার্থ পুঁজিবাদ জড়িত আছে আমরা সেদিকেই ধাবমান হচ্ছি। মাঝেমধ্যে দেখা যায় পরম আত্নীয় বা জ্ঞাতীদের সাথে আমাদের যোগাযোগগুলো ঠিকঠাক ভাবে হয় না। যার কারণে আমাদের সমাজ জাতি রাষ্ট্র এমন কি সমগ্র পৃথিবীতে মানবপ্রেম রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। পৃথিবীর প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, পৃথিবীর সর্বক্ষেত্রে আত্মীয় পরিজন একে অপরের পরিপূরক। আপদ বিপদে সবসময়ে আমাদের জ্ঞাতি স্বজনের প্রয়োজন রয়েছে। কোনো একটা প্রাপ্তি যদি জ্ঞাতি স্বজনকে শেয়ার করতে না পারি, তারাও যদি সেই আনন্দে উৎফুল্ল না হয় তাহলে সে প্রাপ্তিটার পরিপূর্ণতা আমরা দেখতে পায় না। ঠিক অনুরূপভাবে, নিজের দুঃখগুলো যখন অপরকে শেয়ার করতে না পারি, অপরকে পাশে না পায়, সেই দুঃখ থেকে উত্তোলন হতে পারি না। যেমন যদি বলি একটি লঞ্চে বা জাহাজে করে অনেক যাত্রী এক সাথে যাচ্ছে, হঠাৎ জাহাজটা ডুবে যাচ্ছে, পাশে যিনি আছেন তিনি সাঁতার জানেন না কিন্তু আমি তাঁর হাত ধরে তাঁকে কূলে নিয়ে আসলাম জীবন রক্ষা করলাম। আমার কারণে তাঁর জীবনটা রক্ষা পেয়েছে। এটাই হচ্ছে জ্ঞাতি, পরিজন বা মানবতা। একে অপরের সুসম্পর্ক এটি আমাদের জীবনকে রক্ষা করার অনন্য ভূমিকা প্রতিপালন করে। এ রকম পৃথিবীতে ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত দেখতে পায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বর্তমান সময়ে সেই জ্ঞাতি পরিজন, আত্মীয় স্বজন, ভাইবোন আমরা সবাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে একাকীত্বে থাকতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বলি, একান্নবর্তী পরিবার ছিল তখন কত আনন্দ ও উল্লাস ছিল। ছোট খাট সমস্যা হলেও একে অপরের পরিপূরক হয়ে সুখে দুঃখে কাছে থাকা, একসাথে পরিবার পরিজন নিয়ে খাওয়া, ঘুরতে যাওয়া, খেলাধুলা করা, স্কুলে যাওয়া, পড়তে বসা, প্রার্থনা করা, বিহারে বা মক্তবে যাওয়া, কেনাকাটা করা এবং মাঝেমধ্যে বনভোজন করা ইত্যাদি বাড়ির মধ্যে এক মহানন্দ লেগেই থাকতো। কিন্তু আজ সেগুলো নেই বললেই চলে। সব হারিয়ে যাচ্ছে কালের গতিতে। আমরা বড় বেশি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত এক কথায় আত্মকেন্দ্রিক। মা-বাবা থেকেও আমরা দূরে চলে যাচ্ছি এবং বয়োবৃদ্ধ কালে মা-বাবাও একাকীত্ব জীবন যাপন করছে। যখন তাঁরা অবসর সময়ে নাতি নাতনী ছেলেমেয়েদের সাথে কথাবার্তা বলে গল্পগুজব করে উৎকৃষ্ট সময় অতিবাহিত করবে সেই সময় আমরা তাঁদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছি বা আলাদা হয়ে যাচ্ছি। বিশেষ করে ছেলেমেয়েগুলো যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা হয় তখন মা-বাবার সাথে কোন যোগাযোগ থাকে না। এই যে আমাদের পরিবার পরিজনের সাথে সুসম্পর্ক এগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে, পশু-পাখির মত জীবন হয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি পশু-পাখিরা জন্ম গ্রহণের পর থেকে যৌবন প্রাপ্তি পর্যন্ত মা-বাবাকে চিনে এরপর মা-বাবাকে তারা আর চিনে না। মানুষতো আর পশুপাখির মত হওয়ার কথা নয়। মানুষের বোধজ্ঞান আছে, চিন্তা করার ক্ষমতা আছে, তাদের বুদ্ধি বৃত্তি আছে, মানবিকতা আছে, তাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনার জন্য প্রচেষ্টা আছে সর্বোপরি ভাল-মন্দ বিচার বিশ্লেষণ করার শক্তি আছে। বুদ্ধ দর্শনে তাই বলা হয়, ‘মানব জন্ম অতি দুর্লভ’। তদ্রুপ মুসলিম দর্শনে বলে, ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ যার বাংলা অর্থ, ‘মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব’। পৃথিবীতে সভ্য জগত তৈরী করার বিশেষ ভূমিকা মানবজাতির। তাহলে মানুষ কেন বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের যৌবন প্রাপ্তি এবং পরিপূর্ণ বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর মা-বাবাকে ভুলে যাবে, পরিবার পরিজনের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হবে, পরিজনদের সাথে কোন যোগাযোগ থাকবেনা, সমাজের প্রতি, ভাইবোনদের প্রতি, মা-বাবার প্রতি সর্বোপরি রাষ্ট্রের প্রতি কোন দায়িত্ব থাকবে না। শুধু যৌবনে মগ্ন হয়ে জীবন ভোগে ব্যতিব্যস্ত থেকে পশুপাখির মত জীবন যাপন কখনোই শোভনীয় হতে পারে না। আমাদের সকলকে অবশ্যই অনেক বেশি মানবিক হয়ে পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনের সাথে একে অপরের সেতুবন্ধন ও তাদের সাথে যোগাযোগ, তাদের সাথে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সামাজিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন উৎসব পার্বন, পারিবারিক উৎসবে প্রত্যেকে একত্রে একতাবদ্ধ হওয়া, আপদ-বিপদে একে অপরকে সহযোগিতা করা, পরের সুখে সুখী হওয়া এবং পরের দুঃখে দুখী হওয়া আমাদের একান্ত আন্তরিক দায়িত্ব।
শুধু রক্তের স্রোতধারাই নয় পৃথিবীতে সুখী সমৃদ্ধ ও সুন্দর করে বাঁচতে হলে সবাইকে আপন করে আত্নীয়ের সেতুবন্ধনে পরম মমতা ও ভালোবাসার স্রোতধারাই আপন করে নিতে হবে। তাই কবি গুরু বলেছেন-
“কত অজানারে জানাইলে তুমি
কত ঘরে দিলে ঠাঁই/ দূরকে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই”।
এ জগতে দূরের মানুষগুলোকে নিকটে করতে হবে পরকে ভাই করতে হবে। এভাবে যদি আমরা সেতুবন্ধন রচনা করতে পারি তাহলে আমাদের জীবনটা সুখময় হবে। তাই বুদ্ধের দর্শনেও দেখি, তিনি তাঁর প্রতিটি ক্ষেত্রেই পৃথিবীর সকল প্রাণীর সুখের কথা বলেছেন। অপর যদি সুখী না হয়, অপরকে যদি ভালোবাসতে না পারি , অপরের মঙ্গল যদি কামনা করতে না পারি তাহলে নিজে কখনো সহজে সুখী হতে পারবো না। তাই পৃথিবীর প্রত্যেকটি ধর্ম দর্শনসহ মহামনীষীগণ একবাক্যে বলেছেন, “নিজে যেমন সুখী হতে চাও তেমনি অপরের সুখও কামনা করা প্রকৃত মানবধর্ম। অপরকে সুখী করতে হলে তার আপদবিপদে পাশে থেকে যোগাযোগ, আন্তরিকতার সেতুবন্ধন এবং সম্পর্ক রক্ষা করা একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই মনে করি, এটাই পারিবারিক ও সামাজিকভাবে শিক্ষা নেওয়া দরকার। প্রত্যেকের ত্যাগশীলতা হওয়ার শিক্ষা থাকতে হবে, একে অপরের প্রতি মান্য, গণ্য ও শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে এবং আত্নীয়ের বন্ধন সুন্দর, মজবুত ও দৃঢ়তা থাকতে হবে।
আমরা ছোটকালে যেমন দেখতাম বাচ্চাদের সাথে বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখা সাক্ষাত হলে মাতাপিতারা পরিচয় করে দিতেন- উনি সম্পর্কে তোমার কাকা হন, চাচা হন, মামা হন উনাদের প্রণাম বা সালাম কর। এভাবে প্রজন্মদের ছোটকাল থেকে আত্নীয় বা জ্ঞাতির সম্বন্ধ গুলো রচনা করে দিতেন পিতামাতারা কিন্তু এখন মা-বাবাদের ক্ষেত্রে সেরূপ দেখা যায় না। সন্তানদের সাথে পরিচয়টা তেমনিভাবে না হওয়াতে শিশুরা আত্মীয়তার সম্পর্ক গুলোকে কিভাবে বিচার বিবেচনা করবে তাও বুঝে উঠতে পারে না। তাই বিশ্বমানবের পরিবার, ধর্ম, আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধায় স্বজনের সেতুবন্ধন গুলো রচনা করা একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। পরিশেষে শ্রদ্ধেয় কবি কামিনী রায়ের বিখ্যাত সুখ কবিতাটির লাইন দিয়ে বলি, ’আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’।
লেখক : প্রবন্ধকার ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেসরকারিভাবেও টিকা দেবার ব্যবস্থা করলে মানুষ বাঁচবে
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীর পুতা বেগুন : একটি সম্ভাবনাময় সব্জি ফসল