চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে অবকাঠামোগত ও ক্লিনিক্যাল যন্ত্রপাতির স্বল্পতাসহ সুুনির্দিষ্ট আটটি সমস্যা রয়েছে বলে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে। সমস্যাগুলো একাধিকবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে সহায়তাও চেয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু প্রত্যাশিত সহায়তা পাওয়া যায়নি। আবার আর্থিক সংকটের কারণে দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলোর সমাধান করা চসিকের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে প্রকট হচ্ছে সমস্যাগুলো। ফলে নানামুখী সমস্যার কারণে দিন দিন নগরবাসীর আস্থা হারাচ্ছে চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে ১২ লাখ ৯১ হাজার ৫৯৫ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে চসিকের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো থেকে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ২৬ হাজার ৯৮৪ জন। স্বাস্থ্যসেবার বিপরীতে গত বছর চসিকের আয় হয়েছে চার কোটি ৪২ লাখ ৪৬ হাজার ১২০ টাকা। অবশ্য প্রতি বছর চসিককে ১৩ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয় স্বাস্থ্য বিভাগে। উল্লেখ্য, চসিকে ১০০ শয্যার একটি মেমন মাতৃসদন হাসপাতাল, ১০০ শয্যার একটি জেনারেল হাসপাতাল, ৫০ শয্যার তিনটি মাতৃসদন হাসপাতাল, ৫৩টি দাতব্য চিকিৎসালয় ও নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৩৩৫টি ইপিআই টিকাদান কেন্দ্র, ১০টি হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয় রয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে মেমন মাতৃসদন অবকাঠামোগত এবং ক্লিনিক্যাল যন্ত্রপাতি দিয়ে সহযোগিতা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পত্র দিয়েছিল চসিক। কিন্তু এতে সাড়া দেয়নি মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দীর্ঘদিনের দাবি। যে বরাদ্দ এ খাতে দেওয়া হয়, দেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য তা খুবই অপ্রতুল। ফলে মানুষকে নিজের পকেট থেকে প্রায় ৬৬ শতাংশের মতো খরচ করতে হয় বলে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে। অর্থাৎ স্বাস্থ্যের পেছনে ১০০ টাকা খরচ হলে সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় ৩৪ টাকা এবং বাকি ৬৬ টাকা রোগী নিজে বহন করে। এটি হয়তো বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা যাদের আছে তাদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু স্বাস্থ্য চাহিদা মেটাতে এই অর্থের সংকুলান করাটা জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশের জন্য বেশ কঠিন। অবশ্য স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কিছু লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের যে প্রশংসনীয় অগ্রগতি হয়েছে, সেটি না বললেই নয়। যেমন আমাদের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল ২০২০ তে এসে ৭২.৬ বছরে উন্নীত হয়েছে, যা ২০০৫ সালে ছিল ৬৫.২ বছর। ২০১৭ সালে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৪ জনে দাঁড়ায়, যা ২০০৫ সালে ছিল ৫০ জন। পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার ২০০৫ সালে ছিল প্রতি হাজারে ৬৮ জন, যেটি ২০১৭ সালে কমে দাঁড়ায় ৩১ জনে। আর ২০১৭ সালে প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ১৭২ জনে, যা ২০০৫ সালে ছিল ৩৪৮ জন। টিকাদানের পরিধি এবং গর্ভনিরোধক সামগ্রী ব্যবহারের হার বাড়ানো, ডায়রিয়া ও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে কয়েকটি। সাম্প্রতিক করোনা টিকা প্রদানে বাংলাদেশের ভূমিকা অনন্য।
বর্তমান স্বাস্থ্য সেবায় দক্ষ জনশক্তি, আন্তরিকতা এবং উন্নত মান নিশ্চিত থাকায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মত। মানুষ আজ বিভিন্ন কুসংস্কারমুক্ত হয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা সেবা গ্রহণে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। সঠিক প্রচারণা, পলিসি নির্ধারণ এবং জনগণের দোরগোড়ায় আধুনিক চিকিৎসা সেবা পৌছে দিয়ে বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতে এক যুগান্তকারী বিপ্লবের সূচনা করতে সক্ষম হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি যেমন এগিয়ে চলছে, স্বাস্থ্যসেবার পরিষেবাগুলোও বেসরকারি খাতের মাধ্যমে প্রসারণ ঘটছে। এর গুণমান নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উচিত কার্যকরভাবে এই খাতের নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করা। কারণ স্বাস্থ্যসেবার গুণমান এবং ব্যয় অনেকটাই পরিবর্তিত হয় এসব নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারীদের মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে সামগ্রিক জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় দ্বারা শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ওষুধজাত পণ্যের গুণগত মানও পর্যবেক্ষণ করা দরকার। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে আরেকটি অবহেলিত দিক হচ্ছে উন্নত স্বাস্থ্য গবেষণার জন্য নগণ্য সম্পদের বরাদ্দ। স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও মেডিকেল কলেজগুলোকে উন্নতমানের এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা উচিত।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে যেসব সমস্যা বিদ্যমান, তা নিরসনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এগিয়ে আসা উচিত। এ কেন্দ্রগুলোর সমস্যা সমাধানে বরাদ্দ প্রদান জরুরি হয়ে পড়েছে। মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা থাকলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যসেবা পাবে জনসাধারণ। সিটি কর্পোরেশন (চসিক) পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে যে সেবা প্রদান করা হতো অতীতে, তার সুনাম ফিরে আসুক-সেটাই প্রত্যাশা করে নগরবাসী।