চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

ঘষামাজা করে ৪০ কোটি টাকা কমিয়ে দেয়ার ঘটনা দুর্নীতিবাজ অফিসারদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাব : মেয়র

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২৫ at ৭:৪২ পূর্বাহ্ণ

বেসরকারি দুইটি প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিংএর বিপরীতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মূল্যায়নকৃত পৌরকর (গৃহকর ও অন্যান্য রেইট) থেকে ঘষামাজা করে ২০ কোটি টাকা করে ৪০ কোটি টাকা কমিয়ে দেয়ার ঘটনায় সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছে। এতে তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ আনা হয়। এ বিষয়ে তিনি সুদীর্ঘ সময় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় কর্পোরেশন বড় ধরনের রাজস্ব আয় হতে বঞ্চিত হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় নোটিশে। গতকাল সোমবার সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন এ নোটিশ দেন। আজাদীকে বিষয়টি নিশ্চিত করে মেয়র বলেন, যখন অনিয়মটি চিহ্নিত হয় তখন শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম কর্মরত। দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। এতে কর্পোরেশনের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় কমে গেছে। এমনকি যেসব হোল্ডিংয়ে অনিয়ম হয়েছে ওসব হোল্ডিংয়ের পুনরায় রিভিউ করারও উদ্যোগ নেননি। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি হলেও তদন্ত রির্পোট আদায়ে তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি।

এদিকে গতকাল একটি অনুষ্ঠানে মেয়র বলেন, ৪০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেছে এবং দুর্নীতি করেছে। আ জ ম নাছিরের সময় অ্যাসেসমেন্ট হয়। এরপর যখন ঘষামজা করে তখন প্রশাসক ছিল খোরশেদ আলম সুজন। এরপর ২০২৩ সালে যখন ঘষামাজা করার বিষয়টি ধরা পড়ে তখন মেয়র ছিলেন রেজাউল করিম। উনিও আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগের সময় কি হয়েছে না হয়েছে আমি বলতে চাই না। আমি দায়িত্ব নিয়ে জানুয়ারিতে একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। ৮/৯ মাস ধরে রির্পোটটি দিতে পারছিল না, এটা খুবই দুঃখজনক।

তিনি বলেন, আমি অবশ্যই দুর্নীতিবাজ অফিসারদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাব। এ ঘটনায় যারা জড়িত আমি বরখাস্ত করেছি। এখানে যারা উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত আছে তারাও এর বাইরে নয়। তাদের ব্যাপারেও অ্যাকশনে যাব। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাচ্ছি। তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিব।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইছহাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও ইনকনট্রেড লিমিটেডএর পৌরকর নির্ধারণে ২০১৭২০১৮ অর্থবছরে বার্ষিক মূল্যায়ন (অ্যাসেসমেন্ট) করা হয়। এর মধ্যে ইছহাক ব্রাদার্সের হোল্ডিংএর বিপরীতে ২৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা ও ইনকনট্রেড লিমিটেডএর হোল্ডিং এর বিপরীতে ২৫ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা পৌরকর নির্ধারণ করেন এসেসর। পরবর্তীতে আপিল রিভিউ বোর্ডের শুনানিতে উপস্থাপনের সময় ‘ফিল্ডবুক’ এবং ‘পি ফরম’ (কর নির্ধারণ ও মূল্যায়নের বিরুদ্ধে আবেদন ফরম) থেকে ‘২’ সংখ্যাটি মুছে দেয়া হয়। অর্থাৎ ২৫ কোটি ও ২৬ কোটি থেকে ২ মুছে দেয়া হয়। এতে কমে যায় ২০ কোটি টাকা টাকা করে ৪০ কোটি টাকা। ফলে ইছহাক ব্রাদার্সের হোল্ডিংএর বিপরীতে মূল্যায়ন ৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা এবং ইনকনট্রেড লিমিটেড এর মূল্যায়ন ৫ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা দেখিয়ে শুনানি করে চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

এ ঘটনায় শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামকে দেয়া নোটিশে বলা হয়, নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অনিয়মের বিষয়টি ২০২৩ সালের ২৮ মে কর্তৃপক্ষ বরাবর উপস্থাপন করা হয়। ওই সময় থেকে গত ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চসিকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অভিযোগটির বিষয়ে দ্রুততার সাথে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের ব্যবস্থা করেননি। দোষী ব্যক্তিদের সনাক্তকরণ এবং হোল্ডিংগুলোর অ্যাসেসম্যান্ট রিভিউ বাতিল করে কর নির্ধারণের বিষয়ে পুনরায় রিভিউর জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। এতে কর্পোরেশন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হতে বঞ্চিত হয়েছে এবং দোষী ব্যক্তিদের যথাসময়ে কোনো শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এতে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ৬২() ধারা অনুযায়ী দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

নোটিশ আরো বলা হয়, প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য গত ৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম চসিকের কর্মস্থল ত্যাগ করেন। এরপর অনিয়মের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকির মাধ্যমে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করা হয়। অভিযুক্তদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অ্যাসেসমেন্ট বাতিল করে পুনরায় রিভিউ করে বিষয়টি নিষ্পত্তির বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

নোটিশের বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, এ ঘটনা আমার নলেজে আসার পর আমার করণীয় হচ্ছে, কর্পোরেশনের ভালো কোনো কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত কমিটি করে দেয়া। সে আলোকেই আইন কর্মকর্তার নেতৃত্বে কমিটি করে দিই। পরবর্তীতে রির্পোট জমা দেয়ার জন্য তাগাদাও দিই। রির্পোট দিতে কেন দেরি হয়েছে সেটা তদন্ত কর্মকর্তাই ভালো বলতে পারবেন।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি চসিকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। গত ৬ সেপ্টেম্বর একটি প্রশিক্ষণে যোগ দেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে গত ২৩ অক্টোবর যোগ দিতে আসলেও তার ‘যোগদানপত্র’ গ্রহণ করা হয়নি। অবশ্য আগেরদিন ২২ অক্টোবর একটি অফিস আদেশ জারি করেন মেয়র। এতে বলা হয়, শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রশিক্ষণ শেষে ফেরত আসার পরে তার যোগদানপত্র গৃহিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সকল বিভাগীয় প্রধানগণ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সচিবএর মাধ্যমে নথি অনুমোদনের জন্য মেয়র বরাবর প্রেরণ করবেন। কর্পোরেশনের কাজের স্বার্থে এই আদেশ জারি করা হল।

এদিকে চসিক সূত্রে জানা গেছে, ইছহাক ব্রাদার্স এর শুনানি হয়েছে ২০২১ সালের ১৩ জুন এবং ইনকনট্রেড লিমিটেড এর শুনানি হয়েছে ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর। পরবর্তীতে অডিটে বিষয়গুলো ধরা পড়ে। সর্বশেষ গত ১৩ জানুয়ারি চসিকের আইন কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মুরাদকে আহ্বায়ক ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির চৌধুরীকে সদস্য সচিব করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত ২০ ও ও ২১ অক্টোবর সিটি মেয়রকে পৃথক দুটি তদন্ত রিপোর্ট হস্তান্তর করা হয়। এতে ঘষামাজা করে ২০ কোটি টাকা করে দুই প্রতিষ্ঠানের ৪০ কোটি টাকা কমিয়ে দেয়ার সত্যতা পাওয়া যায়। এরপর ২২ অক্টোবর বুধবার ঘটনায় জড়িত চসিকের কর কর্মকর্তা নুরুল আলম ও উপকর কর্মকর্তা জয় প্রকাশ সেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া ঘটনায় সহায়তা করায় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় তিন হিসাব সহকারী মঞ্জুর মোর্শেদ, রূপসী রাণী দে ও আহসান উল্লাহকে। একই ঘটনায় উপকর কর্মকর্তা আবদুল কাদের এর জড়িত থাকার সত্যতা পেলেও অবসরে থাকায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়া ২৩ অক্টোবর এ ঘটনায় টাইগারপাস নগর ভবন কার্যালয়ে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তারাও অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। দুদক এ অনিয়মকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্যাটিং ব্যর্থতায় হেরে গেল বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধআকবরশাহ থানার ওসিসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা