চসিকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পৌরকর আদায়

বিদায়ী অর্থবছরে ৪৫৫ কোটি টাকা রাজস্বের মধ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স ৩০৮ কোটি, বেশি আদায় হয়েছে বন্দর থেকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও সেবা বৃদ্ধিতে সক্ষমতা বাড়ল : মেয়র

মোরশেদ তালুকদার | মঙ্গলবার , ১ জুলাই, ২০২৫ at ৪:৫৪ পূর্বাহ্ণ

বিদায়ী ২০২৪২০২৫ অর্থবছরে ৪৫৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এর মধ্যে শুধু পৌরকর (হোল্ডিং ট্যাক্স ও রেইট) আদায় হয়েছে ৩০৮ কোটি টাকা; যা চসিকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গত ২০২৩২০২৪ অর্থবছরে ৩৭২ কোটি ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭৬৬ টাকা রাজস্ব আদায় করে চসিক। ওই হিসেবে বিদায়ী অর্থবছরে আদায় হওয়া রাজস্ব পূর্বের অর্থবছরের চেয়ে ৮৩ কোটি টাকা বেশি। সাধারণ করদাতাদের উপর চাপ সৃষ্টি না করে চট্টগ্রাম বন্দরসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব আদায়ে উদ্যোগ নেয়ায় এ সাফল্য এসেছে বলে আজাদীকে জানিয়েছেন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।

জানা গেছে, পৌরকর ছাড়াও কয়েকটি খাতে কর আদায় করে চসিকের রাজস্ব বিভাগ। খাতগুলোর মধ্যে আছে ট্রেড লাইসেন্স ফি, ভূমি হস্তান্তর কর, বিজ্ঞাপন কর, শপসাইন ফি, প্রমোদকর ফি, যান্ত্রিক যানবাহন ও অযান্ত্রিক ফি। এর বাইরে রাজস্ব বিভাগের আওতাধীন এস্টেট শাখাও রাজস্ব আদায় করে। বিদায়ী অর্থবছরে ২৬ কোটি টাকা ট্রেড লাইসেন্স ফি, ৭৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা ভূমি হস্তান্তর ফি, ৫৫ লাখ টাকা বিজ্ঞাপন কর আদায় হয়। এছাড়া এস্টেট শাখা আদায় করে ৩৫ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ২০১৯২০২০ অর্থবছরে ২৫৩ কোটি ৭ লাখ টাকা, ২০২০২০২১ অর্থবছরে ২৭৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, ২০২১২০২২ অর্থবছরে ৩৪৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা এবং ২০২২২০২৩ অর্থবছরে ৩৫৫ কোটি ৯৩ লাখ ৭০ হাজার ২৬৯ টাকা রাজস্ব আদায় করে চসিক।

রেকর্ড পৌরকর আদায়ের নেপথ্যে সরকারি হোল্ডিং : সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট ২০০৯ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে চসিক পৌরকর আদায় করে। বর্তমানে নগরে সরকারিবেসরকারি হোল্ডিং আছে ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৭২৬টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৩০টি সরকারি এবং ২ লক্ষ ১৭ হাজার ১৯৬টি বেসরকারি হোল্ডিং রয়েছে। বিদ্যমান হোল্ডিংগুলোর বিপরীতে বকেয়া ও হাল দাবিসহ ৩৯০ কোটি ৩৬ লাখ ৪ হাজার ৯৫৬টি পৌরকর অদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৭৮ শতাংশ আদায় হয়েছে। যা পূর্বের (২০২৩২০২৪) অর্থবছরে ছিল মাত্র ৫৪ শতাংশ।

এদিকে বিদায়ী অর্থবছরে রেকর্ড পৌরকর আদায়ের নেপথ্যে রয়েছে সরকারি হোল্ডিংএর বিপরীতে প্রত্যাশিত আদায়। অর্থবছরটিতে সরকারি হোল্ডিং এর বিপরীতে পৌরকারের হাল দাবি ছিল ১০৬ কোটি ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা। বিপরীতে ১৭০ কোটি টাকার বেশি আদায় হয়। যা লক্ষ্যমাত্রার বেশি। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিংগুলোর বিপরীতে ১২৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বকেয়া দাবি থাকলেও আদায় হয়েছে ২৭ কোটি টাকা। এছাড়া বেসরকারি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে ১০৫ কোটি টাকা হাল দাবি থাকলেও আদায় হয়েছে ৭৫ কোটি টাকা। চসিক সূত্রে জানা গেছে, চসিকের নিজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান খাত পৌরকর আদায়। কর্মকর্তাকর্মচারীদের বেতনসহ উন্নয়ন কাজে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ হারে ম্যাচিং ফান্ডের যোগান দিতে হয় চসিককে। এই অর্থের সংস্থানে রাজস্ব আদায়ের উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে পৌরকর আদায়ে বিভিন্ন সময়ে নানা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে চসিক।

বর্তমানে ২৫টি ওয়ার্ড থেকে ১৭ শতাংশ এবং ১৬টি ওয়ার্ড থেকে ১৪ শতাংশ পৌরকর আদায় করে চসিক। ১৭ শতাংশ পৌরকরের মধ্যে ৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স (গৃহকর), ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন রেইট এবং ৭ শতাংশ আর্বজনা অপসারণ রেইট রয়েছে। যেসব ওয়ার্ড থেকে ১৪ শতাংশ পৌরকর আদায় করা হয় ওসব ওয়ার্ডের বর্জ্য অপসারণ রেইট নেয়া হয় ৩ শতাংশ। অবশ্য ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি জারিকৃত সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ৭ শতাংশ গৃহকরের পাশাপাশি ৭ শতাংশ আর্বজনা রেইট, ৫ শতাংশ বিদ্যুতায়ন বা সড়কবাতি রেইট এবং ৮ শতাংশ স্বাস্থ্য রেইট আদায়ের ক্ষমতা আছে প্রতিষ্ঠানটির।

বড় ভূমিকা বন্দরের : এবার সরকারি প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিংগুলোর বিপরীতে বড় অংকের পৌরকর এসেছে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে। বন্দর গত ১৬ এপ্রিল বিদায়ী অর্থবছরের ১০০ কোটি টাকা পৌরকর পরিশোধ করে চসিককে। মেয়র শাহাদাত উদ্যোগ নেয়ার পর বড় অংকের এ পৌরকর আদায় সম্ভব হয়েছে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) কাছে চসিকের নির্ধারিত পৌরকর হচ্ছে ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে নির্ধারিত এ পৌরকরের বিপরীতে চবক পরিশোধ করে আসছিল মাত্র ৪৫ কোটি টাকা। এতে প্রতি বছর ১১৫ কোটি টাকা করে রাজস্ব হারায় চসিক। দায়িত্ব নেয়ার পর চবক থেকে নির্ধারিত পৌরকরের পুরোটাই আদায়ের উদ্যোগ নেন চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। এর প্রেক্ষিতে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর চবক চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয় চসিক। এতে ২০২৪২০২৫ অর্থবছরে বন্দরের পরিশোধিত অংক বাদ দিয়ে বাকি ১১৫ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। পত্রে বলা হয়, চলতি অর্থবছর থেকে ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা পৌরকর ধার্য করা হয়। এরপর চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি নৌপরিবহন সচিবকেও চিঠি দেয় চসিক। এতে চসিকের প্রস্তাবিত পৌরকর পরিশোধে চবককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে বলা হয়। এর প্রেক্ষিতে গত ৬ এপ্রিল চসিককে আপাতত ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করার নির্দেশনা দিয়ে চবক চেয়ারম্যানকে দাপ্তরিক পত্র দেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

কী বলছেন মেয়র : সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আমার টার্গেট ছিল চসিকের আয় বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে আমি সাধারণ করদাতার উপর চাপ সৃষ্টি না করে কর আদায়ের চিন্তা করি। তাই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পৌরকর আদায়ের উদ্যোগ নিই। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরকে টার্গেট করি।

তিনি বলেন, বন্দরে পণ্য আনা নেয়া করা বড় বড় ট্রাকলরি কর্পোরেশনের তৈরিরকৃত রাস্তা ব্যবহার করে। এগুলো মেরামত করতে আমাদের প্রচুর অর্থ খরচ হয়। তাই সার্ভিস চার্জ হিসেবে বন্দরের কাছে তাদের আয়ের ১ শতাংশ অর্থ চেয়েছিলাম। সার্ভিস চার্জ দিলে বছরে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে বন্দরকে। তখন তারা আমাকে রিকুয়েস্ট করে ওটা পৌরকরে এডজাস্ট করতে। তাছাড়া আইনেও সার্ভিস চার্জ দেয়ার সুযোগ নেই। তাই ১৬০ কোটি টাকার যে পৌরকর আমরা পাব সেটাই চেয়েছি। পরে সেটা নিয়ে মন্ত্রণালয়েও যোগাযোগ করি। বন্দরের বাইরে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেও পৌরকর আদায়ে চেষ্টা ছিল।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিং এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় প্রসঙ্গে মেয়র আজাদীকে বলেন, বিভিন্ন হাসপাতাল থেকেও রাজস্ব আদায় হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কর দিত না এমন হাসপাতাল থেকে অনেকটা চাপ দিয়ে আদায় করি। সরকারি এবং বড় বড় প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব আদায় করায় সাধারণ করদাতাদের উপর চাপ পড়েনি। তবে যারা বড় বড় খেলাফি আছে তাদেরকে বুঝিয়ে ও চাপ সৃষ্টি করেও আদায় করা হয়। সবমিলিয়ে আমাদের সাফল্য এসেছে।

তিনি বলেন, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাওয়ায় নগরের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সেবার পরিধি সম্প্রসারণে আর্থিক সক্ষমতা বাড়ল চসিকের। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আমরা যে বিপুল অংকের ভর্তুকি দিই সেটা আরো বাড়াতে পারব। এতে দুটো খাত আরো সমৃদ্ধ হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোনালাপ
পরবর্তী নিবন্ধকাস্টমসে কাজ শুরু, সার্ভারের ধীরগতিতে ব্যাহত শুল্কায়ন কার্যক্রম