হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘আমার আছে জল’ সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০০৮ সালে। সেই সিনেমার একটি গান ‘বাদলা দিনে মনে পড়ে/ ছেলেবেলার গান/ বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর/ নদে এলো বান/ যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো/ চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে/
এসো গান করি মেঘো মল্লারে/ করুণাধারা দৃষ্টিতে…।’
বরষার রূপ–সৌন্দর্যে বৈচিত্র্য কবি–সাহিত্যিকদের মুগ্ধ করে। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বরষাকে বেশি ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন বৃষ্টিকে। ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো চলে এসো এক বরষায়/ যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো চলে এসো এক বরষায়/ ঝরঝর বৃষ্টিতে জলভরা দৃষ্টিতে/ এসো কোমল শ্যামলও ছায়ায়।’ বৃষ্টিবিলাসী ছিলেন হুমায়ূন। গানটি বেরিয়ে এসেছে এই জনপ্রিয় ও কথাসাহিত্যিক চলচ্চিত্রকারের কলম থেকে। বৃষ্টি তাকে কতটা আন্দোলিত করেছে তার প্রমাণ মেলে গল্প ও উপন্যাসে। তাঁর পরিচালিত বিভিন্ন ছবিতেও তিনি ক্যামেরাবন্দি করেছেন বৃষ্টিকে। বৃষ্টি আর জ্যোস্নাকে নিয়ে তিনি নিত্য খেলা করেছেন।
‘আগুনের পরশমণি’ হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিখ্যাত চলচ্চিত্র। চারদিক বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ডালপালা উত্তাল। এমন আকাশেও একটি হেলিকপ্টার উড়ছে। শুকনো পিচঢালা পথে অল্প অল্প ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। এরপর স্থির পানিতে অঝোরে বৃষ্টি পড়তে থাকে। বৃষ্টিজুড়ে যায় আবহ সঙ্গীতের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের ‘এসো নীপবনে’ গানের সুর বাজতে থাকে।
‘শ্রাবণ মেঘের দিনে’র ছবিতে বৃষ্টি নেমে যায়। দুই দুয়ারী ছবিতে গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির পানি পড়ছে। অন্ধকার রাতে অল্প বাতির আলো। ‘বরষার প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে/ আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয়/ সেদিন তাহার সাথে করো পরিচয়/ কাছে কাছে থেকেও যে কভু কাছে নয়’। ‘দুই দুয়ারী’ ছবিতে নায়ক–নায়িকাদের বৃষ্টিতে ভিজতে দেখা যায়। ‘চন্দ্রকথা’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ ছবিতেও তিনি বৃষ্টিপ্রীতি লুকিয়ে রাখতে পারেননি। এবার তিনি নিজে গান না লিখে দ্বারস্থ হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে’ গানটি। এক পর্যায়ে বেজে ওঠে ‘আমার আছে জল’ গানটি। ‘বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান’ এর সঙ্গে ছবির প্রধান চরিত্রের সাথে মনের একান্ত গোপনভাব ফুটে ওঠে। ঘেটু পুত্র কমলা মেঘমালা ছুটে যাচ্ছে। আকস্মিক বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। তারপর পদ্মপাতার ওপর ঝুম বৃষ্টি পড়তে থাকে। আবহে বেজে উঠে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের করুণ সুর।
হুমায়ূন সাহিত্যকর্মে হিমু অদ্ভূত চরিত্রের নাম। সে কখনো রহস্যময়ী, কল্পনা তার নিত্যসঙ্গী, বৃষ্টি খুব ভালো লাগে। মাঝে–মধ্যে মাথা ন্যাড়া করে, দিনে কখনো রাতের বেলায় উদাসী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। হিমু মূলত একজন বেকার যুবক যার আচরণ অনেকটা অস্বাভাবিক। চাকরির সুযোগ থাকলেও সে চাকরি কখনো করে না বলেই সে বেকার। সে হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে। আবার মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে। হিমুকে পাওয়া যায় – ময়ূরাক্ষী, দরজার ওপাশে, হিমু, পারাপার, এবং হিমু, হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্মসহ আরো অনেক সৃষ্টিকর্মে। তাঁর আরেকটি ব্যতিক্রমী চরিত্র মিসির আলী শুভ্র। মিসির আলীকে নিয়ে উপন্যাস হচ্ছে –দেবী, নিশিথিনী, অন্যভুবন, নিষাদ, বৃহন্নলা, ভয়, বিপদ, অনীশ, মিসির আলীর অমিমাংসিত রহস্য, তন্দ্রাবিলাস, আমিই মিসির আলী, বাঘবন্দী মিসির আলী, হরতন ইশকাপন, মিসির আলীর চশমা, কহেন কবি কালিদাস, মিসির আলী! আপনি কোথায়? মিসির আলী আনসলভ, যখন নামিবে আঁধার। শুভ্র নিয়ে উপন্যাস হচ্ছে –দারুচিনি দ্বীপ, রূপালী দ্বীপ, শুভ্র, এই শুভ্র! এই, শুভ্র গেছে বনে।
হিমু চরিত্রের স্রষ্টা নাটক, সিনেমা, গান, শিশুতোষ বলতে গেলে যেখানে বিচরণ করেছেন, সেখানে স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। বইবিমুখ পাঠককে তিনি বইমুখী করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে /সারা বাংলায় আগুন জ্বলবে, ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি মানি না, মানব না।’ এই ধরনের স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্র বাংলাদেশ। তীব্র আন্দোলনের মুখে নাটকটির শেষ পর্ব প্রচার পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। সংবাদপত্রে বেশ ফলাও করে এসব সংবাদ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’র জনপ্রিয় চরিত্র ‘বাকের ভাই।’ যিনি একজন সন্ত্রাসী, কিন্তু মানবিক গুণে গুণান্বিত। তাঁর চরিত্রকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জনগণের হৃদয় সহজে স্পর্শ করেছে। বাকের ভাই হাতে চেইন ঘুরিয়ে ‘হাওয়া ম্যা উড়তা যায়ে’ গানের সাথে এলাকা চষে বেড়াত। মুনাদের বাড়ির সামনে চায়ের দোকানে বাকেরের আড্ডা ছিল। আপাদমস্তক সন্ত্রাসী চরিত্র বাকেরের আড়ালে মানবিক গুণাবলী হুমায়ূন নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
শিশুদের জন্য তাঁর ভালোবাসা প্রগাঢ়। ‘নীল হাতী’, ‘রূপকথা’, ‘পুতুল’, ‘বোতল ভূত’, ‘নুহাশ এবং আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ’, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা ‘সূর্যের দিন’ এবং রহস্য উপন্যাস ‘অন্যভুবন’ অন্যতম।
বলা যেতে পারে বাংলাসাহিত্যের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক হুমায়ূন আহমেদ। একাধারে কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, শিক্ষক। হুমায়ূন আহমেদের জন্ম নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে, মাতামহের বাড়িতে। পৈত্রিক বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়ার কুতুবপুর গ্রাম। পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। ফয়জুর রহমান আহমেদ পুলিশে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং কর্তব্যরত অবস্থায় পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন। পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে হুমায়ূন আহমেদকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়েছে।
বৃষ্টি ও জ্যোস্না ছিল হুমায়ূনের সবচেয়ে প্রিয়। সেদিন জ্যোস্না না থাকলেও ছিল বৃষ্টি। জ্যোস্নাকে তিনি প্রায় সৃষ্টিকর্মে চেয়েছেন। তাঁর একটা বইয়ে লিখেছিলেন, ‘চাঁদনি পসর রাতে যেন আমার মরণ হয়।’ ‘আসমান ভাইঙ্গা জোছনা পড়ে/ আমার ঘরে জোছনা কই/ আমার ঘরে এক হাঁটু জল/ পানি তে থৈ থৈ/ নিশি রাতে সবাই ঘুমায়/ আমার চোখের নিদ্রা কোথায় রে/ এমনি কইরা দুঃখের বোঝা/ আর কত কাল বই/ আমার ঘরে এক হাঁটু জল/ পানি তে থৈ থৈ।’ ২০১২ সালের ১৯ জুলাই এক বরষায় এই জনপ্রিয় সাহিত্যিক চিরায়ত নিয়মে দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। বাংলাসাহিত্যের জন্য যা এক অপূরণীয় ক্ষতি।