চলে গেলেন ওসমান হাদি

দেশজুড়ে গভীর শোকের ছায়া, সিঙ্গাপুর থেকে মরদেহ আসবে সন্ধ্যায় । আজ বাদে জুমা বিশেষ দোয়া, কাল রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

আজাদী ডেস্ক | শুক্রবার , ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখভাগের অকুতোভয় যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি আর নেই। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল রাতে ইন্তেকাল করেছেন তিনি (ইন্নালিল্লাহিরাজিউন)। ইনকিলাব মঞ্চের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক সাঈদ হাসান জানান, ওসমান হাদি বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে দেশজুড়ে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। শরীফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুতে আগামীকাল শনিবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে সরকার। হাদির মৃত্যুর খবর আসার পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এ ঘোষণা দেন। ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, শুক্রবার (আজ) বাদ জুমা দেশের প্রতিটি মসজিদে শহিদ ওসমান হাদির রূহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়গুলোতেও বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।

হাদির মরদেহ আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আনা হবে। এনসিপির স্বাস্থ্য সেলের প্রধান ও হাদির চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকা ডা. আব্দুল আহাদ সাংবাদিকদের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘ওসমান হাদির মরদেহ শুক্রবার (আজ) বাংলাদেশ বিমানের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে ৩টা ৫০মিনিটে সিঙ্গাপুর থেকে রওয়ানা হয়ে সম্ভাব্য সময় সন্ধ্যা ৬টা ৫মিনিটে ঢাকায় অবতরণ করবে।’

জুলাই অভ্যুত্থান এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিচিতি পাওয়া হাদি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত শুক্রবার গণসংযোগের জন্য বিজয়নগর এলাকায় গিয়ে তিনি আক্রান্ত হন। চলন্ত রিকশায় থাকা হাদিকে গুলি করে চলন্ত মোটরসাইকেলের পেছনে বসে থাকা আততায়ী। গুলিটি লাগে হাদির মাথায়। গুরুতর আহত হাদিকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্রোপচার করার পর রাতেই তাকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সোমবার দুপুরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে হাদিকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। বৃহস্পতিবার রাতে সেখানে তার মৃত্যুর খবর আসে।

ওই খবরে বিক্ষোভ শুরু হয় ঢাকার শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ রাজধানী এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এরপর রাত সোয়া ১১টার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে আসেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক একটি সংবাদ নিয়ে। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখভাগের অকুতোভয় যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি আর আমাদের মাঝে নেই। কিছুক্ষণ আগে সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান আমাকে টেলিফোনে এই হৃদয়বিদারক সংবাদটি জানিয়েছেন। ইউনূস বলেন, ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী সংগ্রামের এই অমর সৈনিককে মহান রাব্বুল আলামিন শহীদ হিসেবে কবুল করুনএই দোয়া করি।

ওসমান হাদি ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ গড়ে তুলে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আলোচনায় আসেন। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোতেও নিয়মিত আমন্ত্রণ পেতে থাকেন তিনি। তার যুক্তিতর্কের অনেক ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার মাসখানেক আগে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন ওসমান হাদি। তিনি গত নভেম্বরে নিজের ফেসবুক পেজে বলেছিলেন, দেশিবিদেশি অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে তাকে ফোনকল করে এবং মেসেজ পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই পোস্টে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের খুনি ক্যাডাররা তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখছে। তবে প্রাণনাশের আশঙ্কা সত্ত্বেও ইনসাফের লড়াই থেকে পিছিয়ে যাবেন না তিনি।

এদিকে, ওসমান হাদিকে গুলিতে জড়িত মূল সন্দেহভাজন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ফয়সল করিম মাসুদ ও তার সহযোগী আলমগীর শেখ। তারা ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৪ জনকে আটক ও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। তাদের মধ্যে ফয়সালের বাবা হুমায়ুন কবির (৭০) ও মা হাসি বেগম (৬০), স্ত্রী সাহেদা পারভিন সামিয়া ও শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ সিপু রয়েছেন।

হাদির মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রতিবেশী ও স্বজনরা তার ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার গ্রামের বাড়িতে ছুটে আসেন। গত রাত সাড়ে ১০টায় উপজেলার খাসমহল এলাকার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শোকার্ত মানুষের ভিড়। তাদের অনেকেই কাঁদছিলেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা এ ঘটনায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

খাসমহল এলাকার বাসিন্দা এক নারী (৩০) বলছিলেন, হাদির মৃত্যুর খবরে এখানে সবাই শোকাহত। কথা বলার ভাষা নেই। এমন প্রতিবাদী কণ্ঠ নলছিটির গর্ব। এ ঘটনার বিচার না হলে ভবিষ্যতে আর কোনো হাদি জন্ম নেবে না। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সবাইকে জুলাই অভ্যুত্থানের মত ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

আরেক প্রতিবেশী (৫০) বলছিলেন, হাদি দ্বীনের কথা বলতে গিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তার পরিবার খুব ভাল। এই বাংলার জমিনে হত্যাকারীদের অবশ্যই বিচার হতে হবে। এটাই আমাদের চাওয়া।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘ভাইয়া আমার বাচ্চাটারে একটু দেইখেন’ বলে কেঁদেছিলেন হাদি
পরবর্তী নিবন্ধখুলনায় সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা