নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘আপসহীন নেত্রী’ অভিধা পাওয়া খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪১ বছর। তিনি পাঁচবারের সংসদ সদস্য, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী; আর বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন দুইবার। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে নাম লেখানো খালেদা জিয়ার চার দশকের রাজনৈতিক জীবনের বড় সময় কেটেছে রাজপথের আন্দোলনে। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল খেটেছেন; তবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কখনো তিনি হারেননি।
দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৬টায় ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন।
খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান, তারেকের স্ত্রী জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান, খালেদা জিয়ার প্রয়াত ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান, দুই মেয়ে জাহিয়া রহমান, জাফিয়া রহমান, খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, প্রয়াত সাইদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন এস্কান্দার, খালেদা জিয়ার মেজ বোন সেলিনা ইসলামসহ পরিবারের সদস্যরা এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ সময় হাসপাতালে ছিলেন। খবর বিডিনিউজ, বাংলানিউজ ও বাসসের।
খালেদা জিয়ার তার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা দেশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশ–বিদেশের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শোকবার্তা এসেছে দল–মত–নির্বিশেষে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের জানাজা ও দাফন আজ বুধবার অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল যমুনায় উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভার পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনটির সামনে ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। আজ বাদ জোহর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা এবং এর সংলগ্ন মানিক মিয়া অ্যাভেনিউতে অনুষ্ঠিত হবে। জানাজার পর তাকে শহীদ রাষ্ট্রপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পাশে দাফন করা হবে।
খালেদা জিয়ার জানাজা ও দাফন পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। একই সঙ্গে জানাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অংশ নেবেন। এছাড়া সরকারের উপদেষ্টা এবং বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা অংশ নেবেন।
গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘খালেদা জিয়ার জানাজা, দাফন ও আইন–শৃঙ্খলা সমন্বয় নিয়ে বৈঠক’ শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় উনার জানাজা হবে। উনার লাশ সকালেই এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে জাতীয় সংসদ ভবনে নিয়ে আসা হবে। নিয়ে আসার সময় পুরো রাস্তার দুই পাশে একটা স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যারেঞ্জমেন্ট এনসিওর করা হবে। সেখানে নেওয়ার সময় মরদেহবাহী গাড়ির নিরাপত্তায় ১০ হাজার পুলিশ ও এপিবিএন সদস্য মাঠে থাকবেন। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সেনাবাহিনীর সদস্যও দায়িত্বে থাকবেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে সরকার। এছাড়া আজ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
লিভার সংক্রান্ত জটিলতা, কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ও ইনফেকশনজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন খালেদা জিয়া। গত ২৩ নভেম্বর থেকে তিনি বসুন্ধরায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে তার বড় ছেলে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং পরিবারের সদস্যরা সোমবার গভীর রাতে হাসপাতালে ছুটে যান। রাত ২টার পর এজেডএম জাহিদ হোসেন হাসপাতালের সামনে এসে সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়া অত্যন্ত সংকটকময় সময় অতিক্রম করছেন। উনার পরিবারের পক্ষ থেকে উনার সুস্থতার জন্য মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে দেশবাসীকে দোয়া করার আহ্বান জানাচ্ছি।
এর কয়েক ঘণ্টা পর হাসপাতালের চিকিৎসকরা বিএনপি চেয়ারপারসনকে মৃত ঘোষণা করেন। সেই খবরে তাৎক্ষণিকভাবে শোকের ছায়া নেমে আসে। হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্সদের অনেককে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। এই শোক সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনেকেই শোক প্রকাশ করে পোস্ট দেন। বিএনপির নেতাকর্মী আর সমর্থকরা জড়ো হতে থাকেন এভারকেয়ার হাসপাতালের বাইরে।
পরে সকাল ৯টায় খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার সাংবাদিকদের সামনে এসে কান্নাভেজা কণ্ঠে












