এবারে পি কে ডি প্রোগ্রাম করল আইসল্যান্ড বেড়াতে যাবে। শুনেই শীত শীত লাগছিল। শীতকাতুরে বলে বদনামও কুড়িয়েছি এতদিন। আবার এত সুন্দর একটি দেশ দেখার ইচ্ছে থেকে দূরে থাকতেও পারছিলাম না। তাই শীতের ভয় একপাশে সরিয়ে রেখে তৈরি হচ্ছিলাম আইসল্যান্ড যেতে।
আইসল্যান্ড ইউরোপ মহাদেশের একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। রাজধানীর নাম রেইকিয়াভিক। রেইকিয়াভিক নামের অর্থ ‘ধোঁয়াটে উপসাগর’। দেশটিতে অবস্থিত ভূগর্ভস্থ উষ্ণ প্রস্রবণগুলোর আধিক্যের কারণে দ্বীপটি সারা বছর তুষারাবৃত থাকা সত্ত্বেও উষ্ণতার অভাব হয় না।এমনকী এই ভূগর্ভস্থ উষ্ণতাকে ব্যবহার করে জিও থারমাল পদ্ধতিতে আইসল্যান্ডের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো হয়ে থাকে। আইসল্যান্ড গ্রিণল্যান্ডের পূর্বে ও উত্তর মেরুরেখার দক্ষিণে মধ্য আটলান্টিক পর্বতমালার উপর অবস্থিত। আইসল্যান্ড একটি আগ্নেয় দ্বীপও বটে! অবাক লাগছে? নাম আইসল্যান্ড। আবার আগ্নেয়দ্বীপও বলছি। বহু মিলিয়ন বছর ধরে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে দ্বীপটির সৃষ্টি। এখনও দ্বীপটিতে অনেক সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে। ভূমিকম্প তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
ভৌগোলিকভাবে অনেক উত্তরে সুমেরুর কাছে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের উষ্ণ উপসাগরীয় সমুদ্রস্রোতের কারণে এখানকার জলবায়ু অনেকটাই উষ্ণ থাকে। এই তথ্য পাওয়ার পর আইসল্যান্ডে যেতে সাহস পেলাম। আর প্রচুর উষ্ণ প্রস্রবণের উপস্থিতির কারণে দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও এখানে মানববসতি বিদ্যমান। আইসল্যান্ডের পর্বতশ্রেণিগুলোর ১১% হিমবাহে আবৃত থাকে। দেশটি সারা বছর বরফে ঢাকা থাকলেও বেশ কিছু ঝর্ণা দেখতে পেয়েছিলাম।এদের মধ্যে অনেকগুলো যে শক্তিতে উঁচু পাহাড় থেকে ঝরে পড়ছিল অভিভূত হয়ে দেখছিলাম।বরফের দেশে জলপ্রপাত! আর সেই জলপ্রপাত থেকে সৃষ্টি হয় নদী। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট হ্রদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।তাই এই দেশের মানুষদের মাছ খুব পছন্দের খাবার। আইসল্যান্ড রুক্ষ দেশ হওয়ায় এখানে কৃষিকাজ খুবই কম হয়। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট হওয়ায় এখানকার বেশির ভাগ জমি অনাবাদী রয়ে গেছে। মাত্র ১%জমিতে কৃষিকাজ হয়। ২০% জমি পশুচারণের জন্য ব্যবহার করা হয়। বেশকিছু ঘোড়া, খচ্চর টাইপের প্রাণি চোখে পড়েছিল। অল্পকিছু গরু দেখতে পেয়েছিলাম। মাছ ওদের প্রধান রফতানিযোগ্য পণ্য মনে হল। চিকেন , বিফ ,পোরক আমদানি করা হয়।
আইসল্যান্ড হিমবাহ দ্বারা আবৃত পর্বতমালা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও ট্যুরিস্টদের মূলত আকর্ষণ করে ‘মেরুজ্যোতি বা অরোরা বোরিয়ালিস’ এর উপস্থিতির কারণে। এটিকে নর্দার্ন লাইটসও বলা হয়। মেরুজ্যোতি হল আকাশে একধরণের আলোর প্রদর্শনী। মেরুজ্যোতি দেখতে অপূর্ব সুন্দর। তবে সব সময় এর দেখা মিলে না। আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলে এর দেখা মিলে না। সাধারণত মনে করা হয় নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত অরোরা বোরিয়ালিস দেখার উপযুক্ত সময়। তবে তখনও আবহাওয়া বৈরি (তুষার ঝড় , মেঘলা আকাশ ইত্যাদি) থাকলে এই জ্যোতিপ্রভা দেখা যায় না। আইসল্যান্ডে চারদিনের অবস্থানকালে আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল একরাতে মেরুজ্যোতি দেখার স্বল্প সময়ের জন্য হলেও। বেশির ভাগ সময় এটি সবুজ রঙের হয়। তবে কমলাভ, লাল , নীল রঙেরও দেখা যায়। মেরুজ্যোতির রঙ নির্ভর করে বায়ুমন্ডলে স্থিত কণাগুলোয় গ্যাসের উপস্থিতির ওপর।মেরুজ্যোতি সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হল মেরু অঞ্চলের বায়ুমন্ডলে বিশেষত্বের জন্য তথায় স্থিত কিছু কণা দিনের বেলায় সূর্যরশ্মি থেকে এনার্জি সংগ্রহ করে রাখে।তবে এই কণাগুলো অনির্দিষ্টকাল নিজের মধ্যে ধরে রাখে না।অনুকূল পরিবেশ (পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র এবং সূর্যরশ্মির গতির মধ্যে বিক্রিয়া এবং বিভিন্ন তারতম্যের কারণে পূর্বোক্ত জমে থাকা এনার্জি বা শক্তি হঠাত হঠাত বায়ুমন্ডলে অবমুক্ত হয়ে এই অপূর্ব প্রাকৃতিক আলোকচ্ছটা সৃষ্টি করে। এই অপার্থিব সৌন্দর্য দেখার পূর্ব শর্ত হল নিকষ কালো অন্ধকার এবং মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশ। আর এই জিনিসটিই মানুষকে আইসল্যান্ডে যেতে খুব উৎসাহিত করে।