চট্টগ্রাম বন্দরে ২০২১ সালে কোন ধরনের জলদস্যুতার ঘটনা ঘটেনি। বন্দরের বহির্নোঙর এলাকা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বিস্তৃত হলেও পুরো বছরে একটিও জলদস্যুতার ঘটনা না ঘটার বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক শিপিং সেক্টরের জন্য বড় ধরনের অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের ইমেজ বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলদস্যুতার প্রকোপ রয়েছে। বিশেষ করে সোমালিয়া থেকে শুরু করে আফ্রিকান দেশগুলোতে জলদস্যুতার প্রকোপ খুবই বেশি। ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলদস্যুতার ঘটনা ঘটে। ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন অংশে জলদস্যুতার বহু ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরেও এক সময় জলদস্যুতার প্রকোপ ছিল। অবশ্য রশি, রঙের ড্রামসহ নানা ধরনের ঠুনকো জিনিসপত্র চুরির ঘটনাও জলদস্যুতা হিসেবে আন্তর্জাতিক শিপিং সেক্টরে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছিল। আন্তর্জাতিক শিপিং সেক্টরে জলদস্যুতার রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ওই বন্দরে বিদেশি জাহাজ আসতে চায় না। দস্যুদের জন্য বন্দর চরমভাবে ইমেজ ক্রাইসিসে পড়ে। অনেক সময় বাড়তি ভাড়া দিয়ে জাহাজ আনতে হয়। এতে আমদানি বাণিজ্যে মারাত্মক রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে ভোক্তা পর্যায়ে।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অতীতে ছোট খাটো বহু ঘটনাও জলদস্যুতা হিসেবে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশনে রিপোর্ট করা হতো। এতে প্রতিবছরই চট্টগ্রাম বন্দরে অনেকগুলো জলদস্যুতার ঘটনা রেকর্ড করা হতো। যার খেসারত দিতে হতো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ব্যবহারকারীদের। বন্দরে সমুদ্রগামী জাহাজে ডাকাতির ঘটনা বিশ্বের শিপিং সেক্টরের বিভিন্ন সংগঠন নিয়মিত রেকর্ড এবং রিপোর্ট করে থাকে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রিজিওন্যাল কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট অন কমবাইটিং পাইরেসি এন্ড আর্মড রোবারী এগেইনজড শিপ ইন এশিয়া বা রিক্যাপ। জাহাজে সংঘটিত সশস্ত্র ডাকাতি, দস্যুতা ও চুরি প্রতিরোধে এশিয়া ভিত্তিক আন্তর্জাতিক এই সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। প্রতি মাসেই এরা রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিক্যাপের সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে মোট ৭২টি জলদস্যুতার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি ঘটনাও ঘটেনি। চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি সাউথ চায়না জলসীমায়ও ঘটেনি কোন জলদস্যুতা। উক্ত ৭২টি ঘটনার মধ্যে ৫টি ভারতে, ১১টি ঘটনা ঘটেছে ইন্দোনেশিয়ায়, মালয়েশিয়াতে ঘটেছে ১টি ঘটনা, ফিলিপাইনসে ১১টি এবং ভিয়েতনামে ২টি জাহাজে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বিস্তৃত হয়েছে। এক সময় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ছিল মাত্র ৭ নটিক্যাল মাইল। বর্তমানে মোহনা থেকে ২২ নটিক্যাল মাইলে উত্তরে এবং ৪২ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে মিলে সাগরের প্রায় ৬০ নটিক্যাল মাইলেরও বেশি এলাকা বহির্নোঙর হিসেনে জাহাজের আনাগোনা রয়েছে। এছাড়া কুতুবদিয়া, মহেশখালী এবং মাতারবাড়ীসহ বিস্তৃত এলাকায় জাহাজ অবস্থান এবং চলাচল করে। বিস্তৃত এই এলাকায় পুরো বছরে সমুদ্রগামী জাহাজে কোন ধরনের ডাকাতি বা জলদস্যুতার ঘটনা না ঘটার ব্যাপারটিকে বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনেক বড় অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। চলতি বছরে আর মাত্র দুইটি দিন পার করে দেয়া গেলে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে কোন অঘটন না ঘটার রেকর্ড তৈরি হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় ২০১০ সালে সর্বোচ্চ ২১টি জলদস্যুতার ঘটনা ঘটে। ২০১১ সালে ঘটেছিল ১৪টি। এছাড়া ২০১২ সালে ১২টি, ২০১৫ সালে ১০টি, ২০১৬ সালে একটি, ২০১৭ সালে ১১টি এবং ২০১৮ সালে ৯টি ঘটনা রেকর্ড করে রিক্যাপ। ২০২০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ৩টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে গত এক বছরে কোন ধরনের চুরি ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। এটি অনেক বড় একটি অর্জন। চট্টগ্রামে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের সমন্বিত কার্যক্রমের ফলে বহির্নোঙরে কোন ধরনের অঘটন ঘটেনি বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ওয়ার্ল্ড মেরিটাইম অর্গানাইজেশন বা অন্যান্য সংস্থাগুলোর রিপোর্টে বিষয়টি উল্লেখ করায় বন্দরের ইমেজ বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। তিনি আরও বলেন, দেশে ডাকাত নেই, বন্দরে ডাকাতি হয় না এটিই দেশের আমদানি বাণিজ্যের জন্যও অনেক বড় একটি স্বস্তির ব্যাপার। এতে শুধু বন্দরেরই নয়, দেশেরও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।