চলছে শুটকি উৎপাদন

বেড়েছে ব্যস্ততা, দেশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশেও

মহেশখালী ও বাঁশখালী প্রতিনিধি | রবিবার , ২১ নভেম্বর, ২০২১ at ৯:১৪ পূর্বাহ্ণ

শুষ্ক মৌসুম, সমুদ্র উপকূলীয় এলাকাগুলোতে শুরু হয়েছে শুটকি উৎপাদন। বেড়েছে শুটকির সাথে জড়িত মানুষের ব্যস্ততা। দেশের নানা প্রান্তে যায় এসব সবজি। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।
মহেশখালী প্রতিনিধি জানান, কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নের সোনাদিয়া দ্বীপে শুরু হয়েছে শুটকি উৎপাদন। এই দ্বীপে শুষ্ক মৌসুমে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত শুটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। শুটকি খাতে আয় হচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। শুটকি উৎপাদন ঘিরে মহেশখালীর নারী-পুরুষ মিলে প্রায় ২০ হাজার জেলের কর্মসংস্থান হয়েছে।
সোনাদিয়া দ্বীপের আয়তন ৭ বর্গকিলোমিটার। কক্সবাজার জেলা সদর থেকে ৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মহেশখালী চ্যানেলের মহেশখালী দ্বীপের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত এই উপদ্বীপ। সোনাদিয়ার চরে এখন শত শত জেলে অস্থায়ী কেল্লা তৈরি করে কোটি কোটি টাকার মাছ শুকিয়ে শুটকি তৈরি করছেন।
সোনাদিয়ার শুটকি মহাল ঘুরে শুটকি উৎপাদনে জড়িত লোকের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানে উৎপাদিত শুটকির মধ্যে লইট্টা, চিংড়ি, ফাসিয়া, রূপচাঁদা, কামিলা, লাক্ষা, করতি, ছুরি, রুপসা, সুরমা, পোয়া ও বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ উল্লেখযোগ্য। সোনাদিয়া থেকে দৈনিক লাখ লাখ টাকার শুটটি ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া বিদেশে রপ্তানিযোগ্য লাক্ষা, পোয়া, কামিলা, রূপচাঁদাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, সৌদি আরব, দুবাইসহ নানা দেশে রপ্তানি করে ব্যবসায়ীরা আয় করছেন বৈদেশিক মুদ্রা। ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামের আছদগঞ্জ, ঢাকা, সিলেট, বগুড়া, রংপুর, পাবনা, টাঙ্গাইলসহ দেশের বড়-বড় শহরে সরবরাহ করছেন কোটি কোটি টাকার শুটকি। এছাড়া কক্সবাজারের নাজিরারটেক, ধলঘাটার সাপমারার ডেইল এলাকায় শুটকি তৈরির ধুম পড়েছে।
সোনাদিয়া চরের শুটকি ব্যবসায়ী শামসুল আলম জানান, সোনাদিয়ার চরে শুকানো কোটি কোটি টাকার শুটকি ঢাকা, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে চলছে তার জীবিকা। তিনি ২০ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত।
ব্যবসায়ী কলিমুল্লাহ জানান, তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অগ্রিম দাঁদনের টাকা নিয়ে সোনাদিয়া থেকে শুটকি কিনে বিভিন্ন জায়গার নির্ধারিত ব্যবসায়ীকে সাপ্লাই দিয়ে লাভবান হচ্ছেন।
ফিশিং ট্রলারের মালিক ও ব্যবসায়ী সৈয়দ হোছন জানান, তিনি চর থেকে কম দামে কিনে গুদামজাত করেন। বর্ষাকালে দাম চড়া হলে বিক্রি করা হয় গুদামজাত করা শুটকি। এক যুগ ধরে তিনি এ পেশায় জড়িত। সোনাদিয়ার শুটকি মহাল থেকে প্রতি বছর দেশীয় ও বৈদেশিক বাজারে আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকার শুটকি বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
শুটকি উৎপাদনকারী জেলেরা জানান, সোনাদিয়া দ্বীপে উৎপাদিত শুটকি গুদামজাত করার ব্যবস্থা নেই। আধুনিক প্রযুক্তিতে শুটকি উৎপাদনে কারখানা নেই। সনাতন পদ্ধতিতে সৌরতাপে চলছে শুটকি উৎপাদন। এখানে আধুনিক পদ্ধতিতে শুটকি উৎপাদনের ব্যবস্থা ও জেলেদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মৌসুমী ঋণ দানের ব্যবস্থা করা হলে দাঁদন ব্যবসায়ীদের ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পেতেন বলে মনে করছেন তারা।
বাঁশখালীতে ব্যস্ততা : বাঁশখালী প্রতিনিধি জানান, বাঁশখালীর উপকূলীয় ইউনিয়ন সরলের কাহারঘোনা মিনজীরিতলার জালিয়াখালী বাজার সংলগ্ন এলাকা, ছনুয়া, গন্ডামারা-বড়ঘোনা, পুঁইছড়ি, নাপোড়া, শেখেরখীল, শিলকূপের মনকিচর শুঁটকি পল্লীতে এবং বাহারছড়া ও খানখানাবাদের উপকূলীয় এলাকায় শুটকি শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন এ কাজে নিয়োজিত জেলেরা। শীতের শুরুতে বাঁশখালীতে অনেক সময় নিজেরা, অনেক সময় ব্যবসায়ীরা কাঁচা মাছ কিনে শুটকি করে বিক্রি করেন। তাদের দাবি, বাঁশখালী এলাকার অধিকাংশ শুটকিতে ওষুধ কিংবা কেমিক্যাল কম ব্যবহার করা হয়। তাই চাহিদাও বেশ।
উপকূলবর্তী হাজার হাজার মানুষের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম বঙ্গোপসাগর। অক্টোবর মাসে নিষেধাক্ষা প্রত্যহার হলে জেলেরা মাছ ধরতে সাগরে যান।
বাঁশখালীতে যে কয়টি শুটকি পল্লী আছে তার মধ্যে অন্যতম সরল ইউনিয়নের পশ্চিম কাহারঘোনা। এখানে একই স্থানে বেশ কয়েকজন বহদ্দার ও মাছ ব্যবসায়ীর মাছ শুকানো হচ্ছে। এখানকার জেলেপল্লীগুলোতে শুকানো শত শত মণ শুঁটকি ক্রয় করতে চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই, আছদগঞ্জ, খাতুনগঞ্জ ও চকবাজারের গুদাম মালিকরা বাঁশখালীর ব্যবসায় ও জেলেদের অগ্রিম টাকা দাঁদন দেন। ফলে শুটকির দাম বৃদ্ধি পেলেও আড়তদারদের কম মূল্যে শুটকি দিতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীরা। শুটকি শুকানোর কাজে নানা ধরনের শ্রমিক নিয়োজিত থাকেন। বয়স্ক থেকে শিশু ও মহিলা শ্রমিক কাজ করে। তাদের বেতন/মজুরি কাজের পরিধি অনুসারে।
কয়েকজন শুটকি ব্যবসায়ী জানান, আমরা শিশুদের কাজে না রাখলেও তারা এসে বসে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় কাজে না নিলে তাদের পরিবার চলে না। তাই বাধ্য হয়ে নিতে হয়। বেশ কিছু মহিলা শ্রমিক নিয়মিত কাজ করে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় বর্তমানে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে সহজে শুটকি শুকাতে পারেন অধিকাংশ শুটকি ব্যবসায়ী। তারা জানান, মাছের আড়তদার থেকে টাকা নিয়ে এ ব্যবসা করায় তারা লাভের দেখা পান না।
সরলের পশ্চিম কাহারঘোনা এলাকার শুটকি ব্যবসায়ী হাছন আহমদ বহদ্দার জানান, শুকানোর পর তা আড়তদারদের দাম অনুসারে বিক্রি করতে হয়। আমার এ শুটকিপল্লীতে কাজ করছে অনেক শ্রমিক। তাদের কাজের পরিধি অনুসারে ৫-৬শ টাকা করে বেতন দিতে হয় প্রতিদিন। ব্যাংক যদি আমাদের এ কাজের জন্য ঋণ দিত তাহলে ব্যবসার আরো উন্নতি হত। এ ব্যাপারে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধতৃতীয় দিনও জমজমাট রিহ্যাব চট্টগ্রাম ফেয়ার