চলচ্চিত্রে শব্দ ঋত্বিক কুমার ঘটকের Sound in film রহ ঋরষস প্রবন্ধটির অনুবাদ। Sound in film ঘটেকর Cinema and I ও বইয়ের একটি প্রবন্ধ।
প্রায়শ বলা হয়ে থাকে চলচ্চিত্র একটি দৃশ্যগত শিল্প মাধ্যম, আমি শঙ্কিত আমরা হয়ত চলচ্চিত্রে শব্দের গুরুত্ব ভুলত বসেছি। প্রকৃতপক্ষে চলচ্চিত্রে শব্দ ততটাই গুরুত্ববহ যতটা দৃশ্যের নান্দনিকতা গুরুত্বপূর্ণ। আর একটি বিষয় চলচ্চিত্রের সার্বিক আলোচনায় আমরা নির্বাক এবং সবাক উভয় চলচ্চিত্রকেই বুঝিয়ে থাকি। কিন্তু আমার মতে এই ধরণের বিভাজন ভুল, নির্বাক চলচ্চিত্র সম্পূর্ণই ভিন্ন ঘরানার; এর চলন–বলন, ব্যকরণ, বিষয়বস্তু সবদিক থেকেই। নিঃসন্দেহে ব্যাটেলশীপ পটেমকিন, জোয়ান অব আর্ক– এর অভিঘাত আর পথের পাঁচালী– এর অভিঘাত এক নয়। ঠিক যে, নির্বাক চলচ্চিত্রের গর্ভেই সবাক চলচ্চিত্রের জন্ম, যে অর্থে স্থির চিত্র থেকে জন্ম চলচ্চিত্রের। ভাবা যাক একটা বিশৃংঙ্খল দাঙ্গা ধীরে সুশৃংঙ্খল বিপ্লবে পরিণত হল। সবাক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটেছে, নির্বাক চলচ্চিত্রের সাথে শব্দ যুক্ত হয়ে মৌলিকভাবেই চলচ্চিত্রকে পাল্টে দেয়।
কী সে–সব শব্দ যা চিত্রের সাথে যুক্ত হয়ে এই অভূত পরিবর্তন সাধন করল? চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত শব্দকে মূলত পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়– সংলাপ (Dialogue), সংগীত (Music), আনুষঙ্গিক/ ঘটনা উদ্ভুত শব্দ (incidental noise), প্রভাবক শব্দ (Effect Noise) এবং নীরবতা (Silence)।
সংলাপ নিয়ে বিস্তারিত বলার কিছু নেই, এটি স্বরূপে স্পষ্ট। মুখ্যত দৃশ্যের সমন্বয়ে গল্পকে এগিয়ে নেয় সংলাপ।
চলচ্চিত্রে সংগীতের প্রয়োগ ব্যপক, একটা সময় সংগীতই ছিল চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত একমাত্র শব্দ। সংগীতের সঠিক ব্যবহার চলচ্চিত্রকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। সংগীত ব্যবহারের নানা পদ্ধতি রয়েছে। সিনেমা শুরুর আগেই ক্রেডিট লাইনে বাদ্যযন্ত্রের ক’টা তাল পুরো চলচ্চিত্রের সংগীত কাঠামো সম্পর্কে দর্শককে একটা ধারণা দেয়। পরবর্তী দৃশ্যগুলোতেও প্রারম্ভিক সুরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সংগীত ব্যবহার বাঞ্ছনীয়। মূল বিষয় হল সুর যেন ছবির বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
চলচ্চিত্রে সংগীতের ব্যবহার প্রধানত প্রতীকী, অন্তত আমার কাছে। সংগীতের ব্যবহারে সচেতন হওয়া আবশ্যক। উদাহরণসরূপ, কোমল গান্ধার–এর শুরুর দিকে প্রেমের দৃশ্যে কালাবতী রাগের বান্দিশ থেকে ব্যবহার করতে পারতাম। একটি দৃশ্যের সাথে চলনসই হওয়া– এটিই সংগীত ব্যবহারের একমাত্র যুক্তি হতে পারে না। আমি সুরটি একেবারে শেষ দৃশ্যে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের সময় ব্যবহার করেছি, যা ক্লইমেক্সকে অধিক সংবেদী করেছে বলেই আমার ধারণা। কোমল গান্ধার–এর কেন্দ্রীয় থিম দুই বাংলার একত্রিকরণ। এই কারণেই পুরোনো বিয়ের গান বারেবারে ব্যবহার করা হয়, এমনকি বিচ্ছেদ কিংবা বেদনার সময়ও।
সত্যজিৎ রায়ের অপরাজিত আরেকটি উদাহরণ। পথের পাঁচালী–তে একই সুর বারবার শোনা যায় যা অনেকটা থিম মিউজিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পুরো ছবিতে নানা সময়ে সে সুর শোনা যায় যা বাংলার শ্যমল গ্রামগুলোর কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সত্যজিৎ–এর মাধ্যমে চমৎকার ব্যঞ্জনা তৈরি করেন। অপরাজিত–এ সর্বজয়া এবং অপু বেনারস থেকে ফিরছিল, ব্রিজ পেরিয়ে ট্রেন এগিয়ে চলেছে। জানলা দিয়ে দেখি বাংলার চিরায়ত সবুজ, মনোরোম প্রকৃতি। ঠিক সেই সময়ে পথের পাঁচালী–এর সেই থিম মিউজিক বেজে ওঠে, পুরো চলচ্চিত্রে ওই একবারই কিন্তু, তাই যথেষ্ট। সে–সুর স্থায়ী দাগ কাটে দর্শকের হৃদয়ে, বর্তমানের সাথে অতীতের সংযোগ ঘটিয়ে দেয়; দূর্গা, অপুর কাশবন ঘেরা নিশ্চিন্দপুর ভেসে ওঠে দর্শকের মনে।
কখনো সখনো অন্য পরিচালকের ব্যবহৃত সংগীতও একজন পরিচালক ব্যবহার করতে পারেন। আমি নিজেই তা করেছি। লা দল’চে ভিটা–তে ফেলিনি যখন পাশ্চাত্য সভ্যতার বিরুদ্ধে শেষ চাবুকটি কষছিলেন, আমরা শুনি প্যটরিসিয়া গানটি। বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ নিয়েও আমার কিছু বক্তব্য আছে, যা আমি সুবর্ণরেখা–তে বলতে চেয়েছি। আমি বারের দৃশ্যে সে একই সংগীত (লা দল’চে ভিটার) ব্যবহার করেছি। এটি কি অনুকরণ? আমি তা মনে করি না, বুদ্ধিজীবী সমাজ নিয়ে আমার কিছু বলার ছিল যা ঐ নির্দিষ্ট সুর প্রকাশে সহায়তা করেছে।
চলচ্চিত্রে নির্দিষ্ট কোন চরিত্রের জন্য নির্দিষ্ট সুরও ব্যবহৃত হতে পারে। পর্দায় ঐ চরিত্রের উপস্থিতির আগে বা পরে কিংবা উপস্থিতিকালীন একই সুর অনুরণিত হয়। সাধারণত চরিত্রের গুরুত্বকে বাড়াতে এটি করা হয়। প্রায় সময় পরিচালক জামার আস্তিনে লুকিয়ে রাখেন মহার্ঘ অস্ত্র– সংগীত, মোক্ষম সময়ে ব্যবহার করার জন্য। বুনুয়েলের নাজারিন–এর কথা ধরা যাক। পুরো চলচ্চিত্রে সংগীতের ব্যবহার নেই, কেবল শেষ দৃশ্যে একসাথে শত শত ড্রাম গর্জে ওঠে, যারা ছবিটি দেখেছেন তারা এর ব্যঞ্জনা অনুভব করতে পারবেন।
আনুষঙ্গিক/ ঘটনা উদ্ভুত শব্দ চলচ্চিত্রে শব্দ ব্যবহারের আর একটি বড় উৎস। এটি দুইভাবে ব্যবহৃত হতে পারে; দৃশ্যমান উৎস থেকে আর অদৃশ্য উৎস থেকে। একটি দৃশ্যের কথা কল্পনা করা যাক যেখানে একজন নারী এমন একজন পুরুষের জন্য অপেক্ষা করছে যার মুখোমুখি সে হতে চায় না। নারীটি একটি বিছানায় বসে আছে, হঠাৎ–ই লক্ষ্য করল পুরুষটি আসছে। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হল। ঐ একটি ছোট্ট শব্দই মহিলাটির মনোযন্ত্রণা প্রকাশে যথেষ্ট। কিংবা ধরা যাক একটি রাস্তার পাশে দু’জন কপোত কপোতি দাঁড়িয়ে কথা বলছে, তারা সবচে আবেগময় কথাটি যখন বলতে যাবে তখনই একটি গাড়ি তীব্র হর্ণ বাজিয়ে ছুটে গেল, এটি আরেকটি উদাহরণ হতে পারে।
দৃশ্যের সাথে আপাত সামঞ্জস্যহীন শব্দও ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন কোন যুবক যুবতী একটি কক্ষে নির্বাক বসে আছে, দূরের কোন স্থান থেকে পাখির ডাক ভেসে আসছে। অথবা ধরা যাক একজন লোক স্বপ্নময় চোখে হেঁটে চলেছে; খুব ক্ষীণভাবে একটানা ট্রেনের ক্লান্তিকর হুইসেল শোনা যাচ্ছে ইত্যাদি।
শব্দের আলঙ্করিক ব্যবহার চলচ্চিত্রে খুবই কার্যকর। আমি মেঘে ঢাকা তারার একটি দৃশ্যে যেখানে একজন মহিলার যন্ত্রণাভোগ দেখানো হচ্ছে, সাউন্ড ট্রেকে চাবুকের আঘাতের শব্দ ব্যবহার করেছি। আর একধরণের শব্দ আছে যাকে বলা যায় ইফেক্ট সাউন্ড– যা বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরিকৃত। এটি চলচ্চিত্রে বিশেষ মাত্রা যোগ করে। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক– একজন বৃদ্ধলোক একটি বেঞ্চে বসে আছে, ক্যামেরা ব্যক্তিটির মুখে ক্লোজ শটে ধরা। ট্রেনের বগি চলাচল এবং স্টেশনের নানা শব্দ ভেসে আসছে। ঐ শব্দসমূহই বলে দেয় লোকটি স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসা যদিও ক্যামেরা লোকেশনের কিছুই দেখায়নি। অথবা ধরা যাক একজন মহিলার মুখে ক্যামেরা স্থির, একটি লোহার গেট খোলা এবং বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল– এটি মহিলাটি বন্দিত্ব বরণ করতে চলেছে এমন ধারণা দেবে দর্শককে। মেঘে ঢাকা তারা–য় মা চাইছিল না তার বড় মেয়ে প্রেমে পড়ুক কিন্তু কিছুতেই নিবৃত করতে পারছে না, তারা দুইজন যখন কথা বলছিল রান্নাঘর থেকে উত্তপ্ত কড়াইয়ে তেল ফোটার শব্দ আসছিল। পরে কন্যাটিকে যখন অন্য কোথাও দেখি তখনো পৌনঃপুনিকভাবে একই শব্দ শুনি– যার মাধ্যমে মেয়েটির হৃদয়ের তোলপাড় সঞ্চারিত হয় দর্শকের মাঝে।
শেষত: আমি বিশ্বাস করি নীরবতাই হল সবচেয়ে প্রতীকী এবং শক্তিশালী।