চলচ্চিত্র শিক্ষণকে সবার কাছে সহজলভ্য করে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে সম্প্রতি চট্টগ্রামে গঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশে বর্তমানে বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র বিষয়ে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ানো হয়। এছাড়া ঢাকায় রয়েছে একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি ফিল্ম ইনস্টিটিউট। চট্টগ্রামে এ–ধরনের কোনো ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে সম্মান স্নাতক শেষ বর্ষে চলচ্চিত্র বিষয়ে একটি কারিকুলাম রয়েছে। স্বভাবতই এ–সুযোগ কেবল এই বিভাগের শিক্ষার্থীরাই পেয়ে থাকেন।
চট্টগ্রাম থেকে যারা চলচ্চিত্র বিষয়ে শিখতে চান তাঁদের অনেকের পক্ষে ঢাকা কিংবা বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া সম্ভব হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে পড়াটাও সবার পক্ষে সম্ভব নয় নানা অনিবার্য কারণে। চলচ্চিত্র নির্মাণ এখন যেভাবে সহজসাধ্য হয়ে গেছে চলচ্চিত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ–শিক্ষণ সেভাবে সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। এসব বিষয় খেয়ালে রেখে চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা যার যাত্রা শুরু হয়েছে ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ থেকে। এই ইনস্টিটিউট গঠনের নেপথ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম, ঢাকা ও কলকাতার প্রবীণ ও নবীন চলচ্চিত্রকর্মীরা। যাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন ও চর্চায়।
চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু হলো প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্রকার রাজা সেনের হাত ধরে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান সঙ্গীত ভবনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউট ১৮ ও ১৯ মার্চ দু’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করে। এটি ছিল ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। দু’দিনের এই অনুষ্ঠান আয়োজনে ইনস্টিটিউটকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে সঙ্গীত ভবন চট্টগ্রাম। ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় প্রথম দিনের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় সঙ্গীত ভবনের মিলনায়তনে। প্রথমেই অতিথি চলচ্চিত্রকার শ্রী রাজা সেনকে সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানান সঙ্গীত ভবনের নবীন শিক্ষার্থীরা। এরপর শ্রী সেন নবীন কন্ঠশিল্পীদের সঙ্গে সঙ্গীত বিষয়ে আলাপ করেন। দ্বিতীয় পর্বে প্রথমে রাজা সেনকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। সবশেষে অনুষ্ঠিত হয় মিট দ্য ডিরেক্টর সেশন। এই সেশনে তাঁর নিজের শিল্পী জীবন, চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়া, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের পারম্পর্য নিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টার একটি লেকচার ওয়ার্কশপে অংশ নেন রাজা সেন এবং অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেন।
দ্বিতীয় দিন ১৯ মার্চ থিয়েটার ইনস্টিটিউটে প্রথমেই অনুষ্ঠিত হয় নবগঠিত চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অভিষেক। এ–পর্বে ইনস্টিটিউটের ১৭ সদস্য বিশিষ্ট কার্য নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের বরণ করেন শ্রী রাজা সেন। অভিষেকের পর শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর পক্ষে ডা. চন্দন দাশ, খেলাঘরের পক্ষ থেকে আশীষ সেন, সঙ্গীত ভবনের সভাপতি প্রফেসর ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী, চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের দলনেতা অধ্যাপক ম. সাইফুল আলম চৌধুরী ও উচ্চারক আবৃত্তি কুঞ্জের সভাপতি ফারুক তাহের।
এরপর শ্রী রাজা সেন তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে আজ আমি এখানে বিদেশি। অথচ বাংলাদেশ আমার পিতৃপুরুষের দেশ।
পূর্ব পুরুষের ভিটে হিসেবে আমার কাছে এ–দেশ অনেক গর্বের। আর চট্টগ্রাম তো বিপ্লবের তীর্থভূমি। আমি এই বাংলায় এই চট্টগ্রামে বারবার আসতে চাই। তাঁর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘সহস্রাব্দের সেরা বাঙালি’ নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নয় সারা বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণের কাছে তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন চিরদিন। একজন বাঙালি হিসেবে ভালোবাসা, গর্ব ও দায়বোধ থেকে তাঁকে নিয়ে এই প্রামাণ্যচিত্র আমি নির্মাণ করেছি। আজ বীর চট্টগ্রামে প্রথম সেটি প্রদর্শন করতে পেরে আমি অত্যন্ত তৃপ্তি বোধ করছি’। তাঁর বক্তব্যের পর ছবিটি প্রদর্শিত হয় পূর্ণ মিলনায়তনে এবং প্রদর্শনীর পর শ্রী সেন দর্শকদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা করেন। সবশেষে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়ে একটি আলোচনা। এতে মূল বক্তব্য রাখেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বীর শব্দ সৈনিক জনাব ফজল হোসেন। এইভাবে স্বাধীনতার মাসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও আলোচনানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের কার্যক্রমের শুভসূচনা হলো।
এবার চলচ্চিত্রকার রাজা সেন সম্পর্কে কথা বলি। প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা রাজা সেন একাধারে একজন লেখক, থিয়েটার কর্মী, টেলিভিশন সিরিয়াল নির্মাতা, অভিনেতা এবং সর্বোপরি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। তাঁর জন্ম কলকাতার যাদবপুরে ১৯৫৫ সালের ১০ নভেম্বর । পিতৃ পুরুষের ভিটে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জে। মাতুলালয় খুলনায়।
স্নাতক হওয়ার পর প্রখ্যাত নাট্য বক্তিত্ব অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে আসেন তিনি এবং অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল নান্দীমুখে যোগ দেন। এই নাট্যদলে অভিনয় করার সুবাদে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে মৃণাল সেনের একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯) ও আকালের সন্ধানে (১৯৮০) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই সূত্রে মৃণাল সেনের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা পরবর্তীকালে তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণে ফলপ্রদ হয়।
চলচ্চিত্র নির্মাণে রাজা সেনের হাতেখড়ি হয় মোহিত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত মেঘের খেলা ছবির সহকারী পরিচালক হিসেবে ১৯৮২ সালে। মোহিত চট্টোপাধ্যায় ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার এবং কবি। মেঘের খেলার পর রাজা সেন ১৯৮৪ সালে জোছনা দস্তিদার পরিচালিত প্রাগৈতিহাসিক ছবিতে সহকারী পরিচালক এবং বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত ফেরা ছবিতে ১৯৮৬ সালে সহযোগী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনভাবে তিনি কাজ শুরু করেন টিভি ধারাবাহিক নির্মাতা হিসেবে। এই পর্যায়ের কাজগুলির মধ্যে ১৯৮৭ সালে ১৩ পর্বে সুবর্ণলতা, ১৯৯৩ সালে ১৩ পর্বে আরোগ্য নিকেতন, ১৯৮৮ সালে কলকাতা ও দেশ আমার দেশ এবং ১৯৮৯ সালে আদর্শ হিন্দু হোটেল উল্লেখযোগ্য।
একই সময়ে তিনি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণও শুরু করেন। প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে যথেষ্ট দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। তাঁর নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রসগোল্লা (১৯৮৯), ইতিহাসের কলকাতা (১৯৯০), সুচিত্রা মিত্র (১৯৯২), ফিল্ম মেকার ফর ফ্রিডম (১৯৯৪), জ্যোতির্ময়ী দেবী (১৯৯৪), শম্ভু মিত্র (১৯৯৭), সুভাষ মুখোপাধ্যায় (২০০০), সুন্দরবন (২০০২), আলকাপ (২০০৫), সমরেশ বসু (২০০৯) এবং সহস্রাব্দের সেরা বাঙালি (২০২৩) উল্লেখযোগ্য। তাঁর নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে তথ্যের পাশাপাশি কাহিনীরও একটা আস্বাদন পাওয়া যায়। রাজা সেনের তৈরি তৃতীয় প্রামাণ্য চলচ্চত্রি সুচিত্রা মিত্র ১৯৯২ সালে তাঁকে প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এনে দেয়।
রাজা সেন কাহিনীচিত্র নির্মাণে আসেন ১৯৯৬ সালে। তাঁর নির্মিত কাহিনীচিত্র গুলি হলো: দামু (১৯৯৬), আত্মীয় স্বজন (১৯৯৮), চক্রব্যুহ (২০০০), দেশ (২০০২), দেবীপক্ষ (২০০৪), কৃষ্ণকান্তের উইল (২০০৭), তিনমূর্তি (২০০৯), ল্যাবরেটরি (২০১০), মৌবনে আজ (২০১১), কর্ণেল (২০১২), খাঁচা (২০১৩), মায়া (২০১৬), মানবপ্রেমী মহাপুরুষ (২০১৬) এবং ভালোবাসার গল্প (২০১৯)।
১৯৯৬ সালে ছোটদের জন্যে নির্মিত রাজা সেনের প্রথম কাহিনীচিত্র দামু শ্রেষ্ঠ শিশু চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। পরবর্তী ছবি আত্মীয় স্বজন শ্রেষ্ঠ পারিবারিক চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পায় ১৯৯৮ সালে। শ্রী সেনের স্ত্রী পাপিয়া সেন একজন স্বনামধন্য অভিনেত্রী। তাঁদের দুই কন্যা রোমি ও রিমি। রিমি সেনও একজন যশস্বী অভিনেত্রী।