পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে শারীরিক কসরত ও প্রশিক্ষণে যারা উত্তীর্ণ হতেন, নতুন জঙ্গি দল জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সেইসব সদস্যকে পরবর্তী ধাপের প্রশিক্ষণের জন্য দুর্গম পাহাড়ে পাঠানো হত বলে তথ্য দিয়েছে র্যাব। নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব; তাদের বিষয়ে গতকাল শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, কুমিল্লার লাকসাম থেকে ওই চারজনকে গ্রেপ্তার করা করা হয়েছে, যারা বিভিন্ন পেশার আড়ালে জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরা হলেন- মো. আব্দুল কাদের ওরফে সুজন ওরফে ফয়েজ ওরফে সোহেল (২৪), মো. ইসমাইল হোসেন ওরফে হানজাল ওরফে মানসুর (২২), মুনতাছির আহম্মেদ ওরফে বাচ্চু (২৩) ও হেলাল আহমেদ জাকারিয়া (৩৩)। তাদের কাছে উগ্র মতাদর্শের দুটি বই, একটি প্রশিক্ষণ সিলেবাস, নয়টি লিফলেট, একটি ডায়েরি ও চারটি ব্যাগ পাওয়ার কথা বলছে র্যাব। খবর বিডিনিউজের।
কারওয়ান বাজারে র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘আত্মগোপনে থাকার কৌশল হিসাবে তাদের রাজমিস্ত্রী, রঙ মিস্ত্রী, ইলেকট্রিশিয়ানসহ বিভিন্ন পেশার কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। আর সারাদেশে প্রশিক্ষণকালে তাদের রাখা হত সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সদস্যের তত্ত্বাবধানে সেইফ হাউসে।’
গত কিছুদিন ধরে সমতলের জঙ্গিদের পাহাড়ি যোগ আর উগ্রবাদী সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে র্যাব।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, এ পর্যন্ত তিন পাহাড়িসহ ২২ জনকে তারা গ্রেপ্তার করেছেন। তবে নিখোঁজ বা ঘরছাড়া ৫৫ জনের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাদের কেউ এখনও গ্রেপ্তার হয়নি।
মঈন বলেন, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামের বেশ কিছু সদস্য ২০১৭ সালে নতুন এই উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। পরে ২০১৯ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।
‘হুজিবি, জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধ হওয়ায় তাদের পক্ষে সদস্য সংগ্রহ ও অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা দুরুহ হয়ে পড়েছিল। পরে তারা সংগঠন থেকে বের হয়ে নতুন এই উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করেন।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে উগ্রবাদী এই সংগঠনের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণদেরকে ‘টার্গেট’ করতেন। বিভিন্ন সময়ে নানা ভিডিও প্রচার করে এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করতেন তাদের। ‘তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে উৎসাহী করা হত। মোটিভেশনাল কার্যক্রম চালানো হত,’ বলেন মঈন।
তিনি বলেন, বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্র চালনা, বোমা তৈরি, চোরাগোপ্তা হামলা, প্রতিকূল পরিবেশে জঙ্গিদের বেঁচে থাকার বিভিন্ন কৌশল শেখানো হত।
পার্বত্য অঞ্চলের প্রশিক্ষণ শিবিরে ৫০ এর অধিক প্রশিক্ষণার্থী রয়েছে বলে জানা যায়। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমীর মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদের নেতৃত্বে সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে।
এ ছাড়া উগ্রবাদী এই সংগঠনে ছয়জন শূরা সদস্য রয়েছে, যারা দাওয়াতী, সামরিক, অর্থ, মিডিয়া ও উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছে। শূরা সদস্য আবদুল্ল্লাহ মাইমুন দাওয়াতী শাখার প্রধান, মাসকুর রহমান সামরিক শাখার প্রধান, মারুফ আহমেদ সামরিক শাখার দ্বিতীয় ব্যক্তি, মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান, শামীম মাহফুজ প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক এবং ভোলার শায়েখ আলেম বিভাগের প্রধান হিসেবে সংগঠনটিতে দায়িত্ব পালন করছেন।
র্যাব বলছে, পার্বত্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন বম পার্টির কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করতেন এই জঙ্গিরা।
নতুন গ্রেপ্তার চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাতে মঈন বলেন, ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার দাওয়াতী, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, হিজরতকৃত সদস্যদের তত্ত্বাবধানসহ অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন তারা। দুই থেকে চার বছর আগে নিকটাত্মীয়, বন্ধু, স্থানীয় পরিচিতদের মাধ্যমে তারা উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হন।’
গ্রেপ্তারদের পরিচয় জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাচ্চু সংগঠনটির অর্থ বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক, সোহেল ও হানজালা সমগ্র দেশে হিযরত করা সদস্যদের সার্বিক সমন্বয়ক এবং জাকারিয়া সামরিক শাখার তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি। জিজ্ঞাসাবাদে তারা সংগঠনটির আমীরসহ অন্যান্য শূরা সদস্যদের অবস্থান সম্পর্কে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য’ দিয়েছেন।
সংগঠনের আমীর মাহমুদ কুমিল্লা সদর দক্ষিণের একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন। প্রায় দুই বছর আগে চাকরি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এক বছর আগে কুমিল্ল্লার প্রতাপপুরে তার সেমি পাকা বাড়িসহ জমি স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছে ১৭ লাখ টাকায় বিক্রি করে বান্দবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে সাড়ে তিন বিঘা জমি কেনেন এবং পরিবারকে নিয়ে যান। সেখানে তিনি চাষাবাদ, পোল্ট্রি ফার্ম ও গবাদি পশুর খামার পরিচালনা করেন।
সংগঠনটির নারী শাখার বিষয়ে ‘চাঞ্চল্যকর তথ্য’ পাওয়ার কথা জানিয়ে মঈন বলেন, আমরা বেশকিছু মহিলা সদস্যের বিষয়ে জানতে পেরেছি, যারা সংগঠনের চাঁদা প্রদানসহ দাওয়াতী কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তার বাচ্চু চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাংকিং পড়ছিলেন। নতুন জঙ্গি সংগঠনের অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান মোশারফ হোসেন রাকিবের অন্যতম সহযোগী এবং অর্থবিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। জঙ্গি সদস্য শিশির ও রাকিবের মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে দুই বছর আগে তিনি সংগঠনে যোগ দেন।
‘বাচ্চু বলেছেন, গত ৮ থেকে ৯ মাসে বিভিন্ন ধরনের ভারী অস্ত্র কেনার জন্য পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটির কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা, সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য প্রায় ৩০ লাখ টাকাসহ প্রায় ৫০ লাখ টাকা বিভিন্ন স্থানে তিনি পাঠিয়েছেন।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গ্রেপ্তার সোহেল একটি মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করে তিন বছর আগে বাড়ি ছাড়েন। হানজালা কুমিল্লার একটি স্থানীয় মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। সংগঠনের আমীর মাহমুদের একান্ত সহযোগী ও সারাদেশে হিজরত করা সদস্যদের সার্বিক সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। গত মার্চ থেকে এপ্রিলের দিকে ১৭ জন এবং সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ১২ জন তরুণকে পর্যটকের ছদ্মবেশে বান্দরবানে পাঠানো হয়েছে।
‘গ্রেপ্তার জাকারিয়া সিলেটের একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল শেষ করে অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সংগঠনটির সামরিক শাখার দ্বিতীয় ব্যক্তি মানিকের একান্ত সহযোগী ও সংগঠনটির সামরিক শাখার তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি।’