চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ৩৮ দালালকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। গতকাল বুধবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বিভিন্ন বিভাগ ও ওয়ার্ড থেকে মর্গ পর্যন্ত পুরো চমেক হাসপাতালজুড়ে অভিযান চালানো হয়।
র্যাব জানায়, সাধারণ রোগীরা অজ্ঞতার কারণে হাসপাতালে পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হয়। রোগীদের গাড়ি থেকে নামানোর পর ট্রলির ব্যবস্থা করা, ওয়ার্ডে নিয়ে সিট পাইয়ে দেয়ার কথা বলেও টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। হাসপাতালে কয়েক শ্রেণির দালাল চক্র আছে। তাদের মধ্যে একটি চক্র বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা রোগীর স্বজনদের হাসপাতালে চিকিৎসার অপ্রতুলতার কথা বলে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। তাদের আবারো কেউ কেউ হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে দিলে কম দামে করিয়ে দেয়ার কথা বলে বাইরের ডায়াগনিস্টক সেন্টারে নিয়ে যান কমিশনের বিনিময়ে। এছাড়াও হাসপাতালে থাকা নায্যমূল্যের দোকানের পরিবর্তে বাইরের দোকান থেকে রোগীর স্বজনদের ওষুধ কিনতে প্রলুব্ধ করারও একটি চক্র আছে হাসপাতালে।
র্যাবের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আটক ৩৮ জনের মধ্যে ১৪ জনকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকি ২৪ জনকে এক মাসের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
র্যাব–৭ এর সহকারী পরিচালক নুরুল আবসার জানান, সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ পেয়েই হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে অভিযান চালিয়ে দালালদের আটক করা হয়। কোনো রোগীকে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে গেলে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা করে কমিশন পান দালালরা। পরিস্থিতি ভেদে পাঁচ হাজার টাকাও কমিশন পান তারা।
হাসপাতালে যেভাবে রোগীদের হয়রানি করে আসছে দালালরা :
পেশাদার দালালচক্র : জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল এলাকায় গড়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মালিকপক্ষ এলাকার স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, সিএনজি টেক্সি এবং ইজিবাইক চালকদের নিয়ে দালাল চক্র তৈরি করে থাকে। প্রায় প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই দালালচক্রের প্রভাব লক্ষণীয়। দালালরা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কথা বর্ণনা দিয়ে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার প্রতি রোগীদের আস্থার সংকট তৈরি করে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে নিয়ে যায়। এছাড়াও চিকিৎসকরা রোগীদের পরীক্ষা–নিরীক্ষা দিলে সেগুলো দ্রুত করিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এবং কমিশন পাওয়ার আশায় বিভিন্ন কৌশলে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায় এ পেশাদার দালাল চক্র।
শয্যা ও ওয়ার্ড সিন্ডিকেট : প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আগত সাধারণ রোগীরা ভর্তি হওয়ার পর তারা বিভিন্ন পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়। জরুরি মুহূর্তে রোগী বহনের ট্রলি থেকে শুরু করে শয্যা/ওয়ার্ড পাইয়ে দেয়ার কথা বলে দালালরা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে থাকে।
দুরারোগ্য রোগের ভীতি সঞ্চার : তারা হাসপাতালে রোগী আসা মাত্রই রোগীর মধ্যে একটা ভীতি সঞ্চার করে থাকে। রোগীকে তার প্রকৃত রোগের কথা বাড়িয়ে তাকে মরণ ব্যাধি ক্যান্সার বা টিউমার বা অন্য কোনো বড় ধরনের রোগের কথা বলে বেসরকারি কোনো ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায় এবং সেখানে ভর্তি করায়। ফলে রোগীরা সরকারি হাসপাতালের বিনামূল্যের চিকিৎসা ও স্বল্পমূল্যে পরীক্ষা–নিরীক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। এতে অধিক অর্থ ব্যয় করে রোগী ও তার স্বজনরা সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। দালালদের প্রলোভনে পড়ে মানহীন হাসপাতালে যাওয়ায় অনেক সময় সুচিকিৎসার অভাবে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে।
অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট : হাসপাতালে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও তার অপ্রতুলতার গুজব ছড়িয়ে সিন্ডিকেটকারীরা দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেবে বলে ব্যক্তিমালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্স অধিক টাকায় ভাড়া দেয়। এমনকি চিকিৎসাধীন কোনো রোগী এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করার সময় বা কোনো রোগী মৃত্যুবরণ করলে হাসপাতাল থেকে তার লাশ বহনেও সিন্ডিকেট করে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এই দালালচক্রের বিরুদ্ধে।
পরীক্ষা–নিরীক্ষা সিন্ডিকেট : হাসপাতালের চিকিৎসক কর্তৃক রোগীদের রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা দিলে সেগুলো দ্রুত করিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এবং কমিশন পাওয়ার আশায় বিভিন্ন কৌশলে দালালরা তাদের চুক্তিভিত্তিক বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায়।
কমিশন বাণিজ্য : একজন রোগী হাসপাতালে আগমনের পর ভর্তি থেকে শুরু করে রোগী বহনের জন্য ট্রলি, শয্যা/ওয়ার্ড পাইয়ে দেয়া, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরিদর্শনকালে পেছন থেকে সামনে নেয়া, স্বল্পমূল্যে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেয়া, তাৎক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা, স্বল্পমূল্যে উন্নতমানের ওষুধ কেনাসহ সকল ক্ষেত্রে রোগীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কমিশন বাণিজ্য করে আসছে।
পথ্য বাণিজ্য সিন্ডিকেট : সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে রোগীদের বিনামূল্যে সরকার কর্তৃক সরবরাহকৃত ওষুধ নেয়া থেকে পথভ্রষ্ঠ করে স্বল্পমূল্যে উন্নতমানের ওষুধ ক্রয় করে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কমিশনপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট ফার্মেসিতে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ফার্মেসি কর্তৃক ওষুধের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ওষুধের স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে বিক্রয় করে থাকে।