চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। দৈনিক আজাদীতে গত ২৪ ডিসেম্বর ‘বিনামূল্যের ওষুধে টান” শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগীদের বিভিন্ন ওষুধের পাশাপাশি ইনজেকশনও লিখে দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। যদিও প্যারাসিটামল–ওমিপ্রাজল জাতীয় কয়েকটি ছাড়া এসব ওষুধ–ইনজেকশনের অধিকাংশই হাসপাতালে মেলে না। বাইরের ওষুধের দোকান থেকেই কিনতে হয় রোগীদের। তবে বিনামূল্যের এসব ওষুধেও টান পড়েছে ওয়ার্ডে। গ্যাস্ট্রিক বা ব্যথার কমন ওষুধ–ইনজেকশনও পাচ্ছেন না রোগীরা। ক্যান্সারের মতো দামি ওষুধের কথা বলাই বাহুল্য। শুধু ওষুধ নয়, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, স্লাইড, প্লাস্টারের সরঞ্জামের মতো জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জামও মিলছে না ওয়ার্ডে। বিনামূল্যের এসব সরঞ্জামও বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে রোগীদের। ওয়ার্ডে দায়িত্বরতরা বলছেন, হাসপাতাল থেকে সরবরাহ না থাকায় বিনামূল্যের এসব ওষুধ–সরঞ্জাম রোগীদের সরবরাহ করা যাচ্ছে না। সরেজমিনে বিভিন্ন ওয়ার্ডে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তত দুই মাস ধরে বিনামূল্যের অধিকাংশ ওষুধের পাশাপাশি জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় এসব সরঞ্জামের সংকট চলছে হাসপাতালে। তবে ক্যান্সারের ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে। অন্তত ৬/৭ মাস ধরে ক্যান্সার আক্রান্ত গরিব–অসহায় রোগীরা বিনামূল্যের ওষুধ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
হাসপাতাল, ক্লিনিক বা যে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অব্যবস্থাপনা বা অবহেলার কথা উঠলে হাজার হাজার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে আঙুল প্রথমেই ওঠে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে; তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নার্স, ওয়ার্ড বয় বা কর্মচারীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে। কিন্তু হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ নিয়ে অভিযোগ সরাসরি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আসে। এক্ষেত্রে ক্যান্সারের ওষুধের সংকটের কথা স্বীকার করলেও বিনামূল্যের অন্যান্য ওষুধ–সরঞ্জাম একদম না থাকার বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান। আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে হাসপাতাল পরিচালক আজাদীকে বলেন, ক্যান্সারের ওষুধ ক্রয় নিয়ে একটু জটিলতা রয়ে গেছে। যা এখনো সমাধান হয়নি। যার কারণে ক্যান্সারের ওষুধ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। আর বিনামূল্যের অন্যান্য ওষুধ ও সরঞ্জামের কিছুটা সংকট রয়েছে ঠিকই, কিন্তু একদম না থাকার বিষয়টি সঠিক নয়। কিছু কিছু সরঞ্জাম এবার কম কেনা হয়েছিল। ফলে এই সংকট হতে পারে। এটা সাময়িক। নতুন করে ওষুধ–সরঞ্জাম ক্রয়ে এরইমধ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই এ সংকট কেটে যাবে বলে দাবি হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসানের। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত রোগীদের ঠিকানা হয় অর্থোপেডিক ও সার্জারি ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডগুলোতে কাটাছেঁড়ায় প্লাস্টার করানো অপরিহার্য ও অতি জরুরি একটি চিকিৎসা। কিন্তু এসব ওয়ার্ডে গজ–কটন ছাড়া প্লাস্টারের অন্যান্য
কোনো সরঞ্জামই মিলছে না। প্লাস্টার–সফট রোলসসহ জরুরি এসব সরঞ্জামও বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে রোগীদের। ওয়ার্ডে দায়িত্বরতরা জানিয়েছেন, হাসপাতাল থেকে সরবরাহ না থাকায় এসব সরঞ্জাম রোগীদের দেয়া যাচ্ছে না।
অতি সম্প্রতি চিকিৎসাসেবা বিষয়ে পত্রিকান্তরে একটি জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। জরিপে চিকিৎসায় আন্তরিকতা, পর্যাপ্ত সময় দেওয়া, মানসিক সহায়তা, মন দিয়ে রোগীর কথা শোনা, চিকিৎসা বিষয়ে রোগীর সন্তুষ্টি, রোগ সম্পর্কে পরিষ্কার করে বলা, ব্যবস্থাপত্র স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করা, সামাজিক অবস্থানের কারণে বৈষম্য না করা এবং চিকিৎসকের ওপর আস্থা–৯টি সূচকে মতামত নেওয়া হয়। গড়ে ৬৭ শতাংশ রোগী নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন এবং ৩৩ শতাংশ রোগী চিকিৎসকদের বিষয়ে ইতিবাচক। প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী বলেছেন, চিকিৎসকেরা যথেষ্ট সময় দেন না, সামাজিক অবস্থান বুঝে রোগীর সঙ্গে কথা বলেন এবং ব্যবস্থাপত্র স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন না। ৬০ শতাংশ রোগী চিকিৎসায় সন্তুষ্ট না এবং তাঁদের কোনো আস্থা নেই চিকিৎসকের ওপর। অন্যদিকে ৭৭ শতাংশ চিকিৎসক মনে করেন, অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা ঘটলে তাঁদের নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ৭১ শতাংশ চিকিৎসক বলেছেন, রোগী বা তাঁদের স্বজন চিকিৎসার ব্যাপারে সহযোগিতার মনোভাব দেখান না।
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, চিকিৎসক–রোগীর মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। রোধ করতে হবে সম্পর্কের অবনতি। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালে রোগনির্ণয় ব্যবস্থার পরিসর বৃদ্ধির পাশাপাশি জনবল বাড়াতে হবে যেন চিকিৎসকেরা রোগীর জন্য বেশি সময় দিতে পারেন। ওষুধের সরবরাহও বৃদ্ধি করতে হবে। সরকার চিকিৎসাসেবায় যে অনন্য অবদান রেখে যাচ্ছেন, তার সুফল ভোগ করতে হলে বিনামূল্যের ওষুধ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে রোগনির্ণয় ব্যবস্থাও আরো উন্নত করতে হবে।