চমেক হাসপাতালের বিশেষত্ব ও শীর্ষত্ব : প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অদ্যাবধি

ডা. প্রবীর কুমার দাশ | বুধবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশ পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি হাসপাতালের সেবা বিষয়ক মূল্যায়নে চমেক হাসপাতাল শীর্ষ স্থান দখল করেছে। বর্তমানে এই হাসপাতালের অনুমোদিত শয্যা সংখ্যা ২২০০। তার বিপরীতে ২০২২২৩ অর্থ বছরে বরাদ্দ ৭৪ কোটি ৭৯ লাখ। উল্লেখ্য, দেশের সবচেয়ে বড় ঢাকা মেডিকেল কলেজের অনুমোদিত শয্যা সংখ্যা ২৬০০ এবং তার বিপরীতে বরাদ্দ ১৬৭ কোটি ৮১ লাখ। অর্থ্যাৎ তুলনামূলক বিবেচনায় চমেক হাসপাতালের বরাদ্দ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অনেক কম। এমনকি দেখা যাচ্ছে চমেক হাসপাতালের বরাদ্দ তুলনামূলক ভাবে কম শয্যাসম্পন্ন ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকেও কম। সেবায় শীর্যস্থান প্রাপ্তির এই সুসংবাদের সাথে চট্টগ্রামবাসী বিপন্ন বিস্ময়ে এই বৈষম্যের সংবাদ সম্পর্কে অবগত হয়। সাধারণ যেকোনো প্রতিষ্ঠান কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে শীর্ষত্ব অর্জনের প্রাথমিক বিষয় হচ্ছে তার অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তথা সেই প্রতিষ্ঠানের বাজেট বরাদ্দ ও তার উপযুক্ত ব্যবহার। তাই তুলনামূলক কম অর্থ বরাদ্দ সত্ত্বেও চমেক হাসপাতালের এই শীর্ষত্ব এক বিশেষত্ব বৈকি !

এই প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এই বিশেষত্ব ছাড়ার আরো কিছু বিশেষত্ব রয়েছে যা যুগপৎ তার শীর্ষত্বও বটে। এই প্রতিষ্ঠানের শুরুটাই বিশেষত্বপূর্ণ ও স্বকীয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ১৯৫৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। তা উদ্বোধন করতে আসেন তদানিন্তন পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী, তৎকালীন স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত (একাত্তরের বীর শহীদ)। আরো উপস্থিত ছিলেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আলতাফ উদ্দিন আহমেদ, তৎকালীন জেলা মেজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জহির উদ্দিন প্রমুখ। তাদের সাথে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যোগ্য শিষ্য, পরবর্তীতে এদেশের স্বাধীনতারমহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এভাবে জন্মলগ্নে এই মহান পুরুষের আগমন ও স্মৃতিধন্য প্রতিষ্ঠান চমেক হাসপাতাল। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠিত এই মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও চিকিৎসকগণ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেন। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম চার শহীদ এই কলেজের। তারা হলেন চমেক এর ৮ম ব্যাচের চিকিৎসক ডা. কে,বি এনামুল হক, ১২ তম ব্যাচের ছাত্র মো. জাকির হোসেন খান, ৯ম ব্যাচের আবু মো. জসীম উদ্দীন চৌধুরী এবং ১৪ তম ব্যাচের কাজী সাদিক হাসান। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর উত্তম খেতাব প্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. শাহ আলম চমেক এর ১৩ তম ব্যাচের চিকিৎসক। তিনি নৌ কমান্ডো হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহসিকতার জন্য বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। উল্লেখ্য, ডা. শাহ আলমই চিকিৎসকদের মধ্যে একমাত্র বীর উত্তম খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা। প্রতিষ্ঠালগ্নে বঙ্গবন্ধুর গৌরবোজ্জ্বল উপস্থিতিকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০১৮ সালে এই কলেজের আঙ্গিনায় স্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও ‘জাগ্রত রেসকোর্স’। চমেকের এই প্রতিষ্ঠাকালীন বিশেষত্ব বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার শীর্ষত্ব অর্জনে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে চমেক ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠালগ্নে জাতির পিতার সশরীরে উপস্থিতির এইরূপ দুর্লভ ও ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হবার সৌভাগ্য হয়নি। স্বভাবতই এই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের জন্য জাতির পিতার নিরন্তর শুভ কামনা অব্যাহত রয়েছে। এই কারণে তুলনামূলক কম বরাদ্দ নিয়েও এই হাসপাতাল রোগী সেবায় আজ দেশের শীর্ষ সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র। এই শীর্ষত্ব নির্ধারণে সেবা প্রাপ্তির সূচক হিসাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিবেচনায় এনেছে অন্তঃ ও বহিঃ বিভাগে সেবা গ্রহীতা রোগীর সংখ্যা, সেবা গ্রহণে তাদের সন্তুষ্টি, হাসপাতালে অপারেশনের (মেজর ও মাইনর) মোট সংখ্যা, প্রসূতি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারী ও সিজারিয়ানের সংখ্যা, নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি। জরিপে ব্যবহৃত এসব স্বাস্থ্যসেবা কমবেশি সব সরকারি হাসপাতালে চলমান। তবে চমেক হাসপাতালে আরো কিছু বিশেষায়িত সেবা চলমান রয়েছে, যা এই সনাতন পদ্ধতির মূল্যায়নে বিবেচনায় আসেনি। এই বিশেষায়িত সেবার অন্যতম হচ্ছে হৃদরোগ সেবা ও হৃদরোগের শল্য চিকিৎসা সেবা। আমি ব্যক্তিগতভাবে ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করি। চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগই বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, কুমিল্লার দক্ষিণাংশ, লক্ষ্ণীপুর ও নোয়াখালীর একাংশের সরকারি পর্যায়ে হৃদরোগ চিকিৎসার একমাত্র হাসপাতাল। প্রায় চারকোটি জনসংখ্যার এই বৃহৎ অঞ্চলে সরকারি পর্যায়ে অন্যকোনো বিশেষায়িত হৃদরোগ চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান নেই। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলের রোগীদের চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের উপর নির্ভর করতে হয়। এই কারণে গত এক বছরে (জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২২) এখানে বিশ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়। এই সংখ্যা একই সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে ভর্তি রোগীর চেয়ে অনেক গুণ বেশি। চমেক হৃদরোগ বিভাগে ঐ একই সময়ে করোনারী এনজিওগ্রাফী হয় ১,৯৮৬ জনের এবং স্টেন্ট লাগানো হয় ২২৫ জনের। এখানে পেসমেকার লাগানো হয় মোট ১৫৩ জন রোগীর শরীরে। তুলনামূলক ভাবে ঢাকা মেডিকেল ও অন্যান্য মেডিকেলে এই সংখ্যা অনেক কম। চমেক হাসপাতালে স্বল্প খরচে হৃদরোগের এসব বিশেষায়িত চিকিৎসার বদোলতে একই সময়ে এ বিভাগ থেকে সর্বমোট ৫৫ লক্ষ ৬৩ হাজার আটশত টাকা সরকারি আয় হিসাবে কোষাগারে জমা হয়েছে, যা ঢাকাসহ অন্যান্য মেডিকেলের তুলনায় চেয়ে অনেক বেশি । সুতরাং দেখা যাচ্ছে চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ তুলনামূলক কম বরাদ্দ পেয়েও বেশি সেবা প্রদান করেছে এবং বেশি অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা করেছে। এই বিষয়গুলো সেবা প্রদানে শীর্ষত্ব নির্ধারণে বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ চিকিৎসা সেবা অন্য একটা বিশেষ কারণে শীর্ষত্ব ও বিশেষত্বের দাবী রাখে। আমি এ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব থাকাকালীন ২০১৮ সালে চালু করি ‘ডা. ফজলে রাব্বি মুক্তিযোদ্ধা ব্লক’। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও তৎকালীন খ্যাতিমান হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বীর নামে এই ব্লকের নামকরণ করা হয়। একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধারা অনেকে এখন বয়সের ভারে ন্যুজ। তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন হৃদরোগে আক্রান্ত। এই বীর সন্তানদের চিকিৎসা দানে এই মুক্তিযোদ্ধা ব্লক চালু করা হয়। অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সুবিধাসমৃদ্ধ এই ব্লকে ভর্তি থেকে বীর মুুক্তিযোদ্ধাগণ এখন চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করছেন। এই ধরনের মুক্তিযোদ্ধা ব্লক উক্ত মূল্যায়নে বিবেচিত ১৭ সরকারি হাসপাতালের কোথাও নেই। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এ পর্যন্ত এই ব্লকে পাঁচ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশেষায়িত হৃদরোগ সেবা গ্রহণ করেছেন। এই বিশেষায়িত সেবা কার্যক্রম ও কর্মকাণ্ড স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নজরে আনা জরুরি। এই উদ্যোগের অনুসরণে দেশের অন্যান্য হাসপাতালেও এ ধরনের মুক্তিযোদ্ধা ব্লক প্রতিষ্ঠা আব্যশক।

পরিশেষে বলা যায়, চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ চিকিৎসা সেবা এই হাসপাতালের সদ্য অর্জিত শীর্ষত্বের পরিপূরক ও নিয়ামক। তবে পরবর্তী মূল্যায়নে এবং হাসপাতালের সেবার মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধিতে উপরোক্ত বিষয়াদি বিবেচনায় আনা বাঞ্ছনীয়। চমেক হাসপাতাল তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অধ্যাবধি যে শীর্ষত্ব ও বিশেষত্ব প্রদর্শন করে চলেছে তা অব্যাহত থাকুক, এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক : হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও মহাসচিব, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচিরঞ্জীব নাসিমুল গণি
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ৫.৭১ কোটি টাকা