চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক) দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সেবার মানের দিক থেকে সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে গত বছর। স্বাস্থ্যসেবার মান, সেবা গ্রহণকারীদের সন্তুষ্টিসহ নানা দিক বিবেচনা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই শ্রেষ্ঠত্বের কথা ঘোষণা করেছে। এই হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম যা আছে এবং সেসবের ব্যবহার কীভাবে করা হচ্ছে, প্রতিদিন কত রোগী ভর্তি হচ্ছেন, শয্যা কতটা শূন্য, কতটা পূর্ণ হচ্ছে, অতিরিক্ত কত রোগী সেবা পাচ্ছেন, স্বাভাবিক ও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুর জন্ম নেওয়ার হার, বড় ও ছোট পরিসরের অস্ত্রোপচারের সংখ্যা, রক্ত পরিসঞ্চালন কতটা নিরাপদ, রোগীদের সন্তুষ্টির হার কেমন–সব মিলিয়ে দেশের ১৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে র্যাঙ্কিং করে থাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু সেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া যায় না। গত ৪ জুন দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শয্যার হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। ঢামেক হাসপাতালের শয্যা ২৬০০। অপরদিকে চমেক হাসপাতালের শয্যা ২২০০। চলতি ২০২৩–২০২৪ অর্থবছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঢামেক হাসপাতাল (বেতন ভাতা ছাড়া) বরাদ্দ পেয়েছে ২০২ কোটি ৫ লাখ ১৬ হাজার। অন্যদিকে চমেক হাসপাতাল পেয়েছে ৯৯ কোটি ৫০ লাখ ৫ হাজার টাকা। শুধু তাই নয় ১ হাজার শয্যার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের বরাদ্দ পায় ১১৩ কোটি ২৮ লাখ ২২ হাজার টাকা এবং ১২’শ শয্যার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) বরাদ্দ পেয়েছিল ১০৭ কোটি ৩০ লাখ ২৯ হাজার টাকা। এছাড়া ৯০০ শয্যার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বরাদ্দ পেয়েছে ৭৬ কোটি ৫১ লাখ ১৯ হাজার টাকা, ১ হাজার শয্যার শের–ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বরাদ্দ পেয়েছে ৯০ কোটি ৩৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা, ১ হাজার শয্যার রংপুর মেডিকেল কলেজ পেয়েছে ৮৩ কোটি ৮০ লাখ ৬ হাজার টাকা এবং ৯০০ শয্যার সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পেয়েছে ৭৯ কোটি ২৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অথচ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চমেক হাসপাতাল অর্থ বরাদ্দের তালিকায় রয়েছে চতুর্থ স্থানে। শয্যা হিসেবে দেশের অন্যান্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তুলনায় চমেক হাসপাতালের বরাদ্দ বৈষম্যমূলক বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সারা বিশ্বে সমাদৃত। আমরা যদি সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি কাঠামো দেখি, সেখানে মূল জায়গাটিতে বলা হয়েছে, একজন মানুষের প্রথম অগ্রাধিকার স্বাস্থ্যসেবা। মানুষ সেটির মূল কেন্দ্রতে থাকবে। যে সেবাগুলো নেওয়ার জন্য মানুষ যেসব জায়গায় যাবে, সেটি সরকারি বা বেসরকারি হোক, সেবাটি যেন মানসম্মত হয়। তাকে সেবা দেওয়ার কাজে যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করা হবে, সেগুলোও মানসম্মত হতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেশের ধনী মানুষ রয়েছে, তারা তাদের চিকিৎসার ব্যয় নিজেদের মতো করে নিতে পারে। যারা চিকিৎসার ব্যয় নিতে পারছে না, তাদের ক্ষেত্রে সরকার বহন করবে। সেটি একই সেবার আওতায় আসবে। এখানে যেসব নীতি থাকবে, সেটি অবশ্যই সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অনুকূলেই তৈরি করতে হবে। এ জন্য ব্যাপক প্রচার ও প্রসার থাকবে। প্রত্যেক মানুষের সর্বস্থানে এবং সর্বস্তরে স্বাস্থ্য সেক্টরের একটি অ্যাকসেস থাকতে হবে। এটি জন্মগত অধিকার, এটি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতেই হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য দেশের উন্নয়ন হিসেবে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে যখন প্রয়োজন তখনই যেকোনো ধরনের চিকিৎসাসেবা বিনা মূল্যে গ্রহণ করতে পারবে, তখনই আমাদের দেশে ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শয্যাসংখ্যা অনুযায়ী, রোগীর সংখ্যা বিবেচনা করে সেই অনুপাতে বরাদ্দ প্রদানের কথা, কিন্তু সেটি অনুসরণ করা হচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী চমেক হাসপাতাল বরাদ্দ যা পেয়েছে, তার দ্বিগুণ হওয়ার কথা। এই বৈষম্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের হতাশ করছে। অপর্যাপ্ত বরাদ্দের কারণে হাসপাতাল প্রশাসনের পর্যাপ্ত সেবা প্রদানে নাভিশ্বাস হচ্ছে। বিঘ্ন ঘটছে সেবাব্যবস্থাপনায়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেবা মাঝে মাঝে বন্ধ থাকে। চমেক হাসপাতাল সীমিত সাধ্যে যা করেছে, তা সারা দেশের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। কিন্তু সীমাবদ্ধতা তাদের সংকুচিত করে রাখবে। রোগী সেবা ও হাসপাতালের মান বাড়াতে জনবল, সরঞ্জাম বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা। নয়তো সেরা খেতাবটি ধরে রাখা যাবে না। মোট কথা, স্বাস্থ্যের মতো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সরকারের মনোযোগ বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে বরাদ্দ।