চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) এক ছাত্রীর ভাড়া বাসায় দেরি করে প্রবেশকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে চবি ক্যাম্পাস এবং আশপাশের এলাকা। মুহুর্মুহু চলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এতে দুই উপ–উপাচার্য এবং প্রক্টরসহ কমপক্ষে ২শ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৪ জনের অবস্থা গুরুতর এবং একজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এলাকাবাসীর দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। একজন শিক্ষার্থী আইসিইউতে রয়েছেন। তার শরীরে রামদার ছয়টি কোপ লেগেছে। গত শনিবার রাত ১২টার দিকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষ গতকাল রোববার দিনভর চলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন আজ সোমবার পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে। আহতদের মধ্যে ৭০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পুরো ক্যাম্পাসে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। গতকাল সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী না এলেও বিকাল থেকে ১৪৪ ধারা জারির পর ক্যাম্পাসে ও এর আশেপাশে অতিরিক্ত যৌথবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পাসে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন ঘটনা। একের পর এক রক্তাক্ত শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে এসেছেন। চবি মেডিকেল ও চমেকে আহত শিক্ষার্থীদের আহাজারি লক্ষ্য করা গেছে।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, স্থানীয়দের মধ্যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে। শিক্ষার্থীরা ছিল নিরস্ত্র, অপরদিকে স্থানীয়দের হাতে বড় বড় রামদা, শটগান, মাথায় ছিল হেলমেট। শিক্ষার্থীদের এলোপাতাড়ি কোপানো হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী গ্রামের মধ্যে আটকা পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাহায্য চেয়েছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা স্থানীয়দের দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায়। কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা সিস্টেমেটিকভাবে সমাধান করা দরকার ছিল বলে মনে করেন তারা। এছাড়া শনিবার বিষয়টি সমাধান করে ফেলা যেত বলে জানান তারা।
সংঘর্ষের সূচনা : শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ২ নম্বর গেট এলাকায় ভাড়া বাসায় ফিরছিলেন এক ছাত্রী। দেরি করে আসায় দারোয়ান তাকে ঢুকতে বাধা দেন এবং হেনস্তা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। খবর পেয়ে কয়েকজন ছাত্র সেখানে গেলে দারোয়ান ভয়ে পালিয়ে যান। ফেসবুকে খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে জড়ো হন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ : গতকাল বিকাল ৪টা পর্যন্ত পুলিশ বা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখা যায়নি বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। উপ–উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন দুপুর ৩টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা কোন জগতে আছি? পুলিশ নেই, কোনো কিছু নেই। আমরা জিওসির সাথে কথা বলেছি, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাথে কথা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে জানিয়েছি। দুই ঘণ্টা চলে গেলেও কেউ আসেনি। আমার শিক্ষার্থীদের স্থানীয়রা কচুকাটা করছে। পরে ১৪৪ ধারা কার্যকর হওয়ার পর বিকাল ৪টার দিকে র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। যৌথ অভিযান পরিচালনা করে।
উপ–উপাচার্য ও প্রক্টরসহ একাধিক আহত : সংঘর্ষের সময় স্থানীয়দের ধাওয়ায় উপ–উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রক্টর তানভীর হায়দার আরিফ ইটের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এছাড়া উপ–উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মো. শামীম উদ্দিন খান ও নিরাপত্তাকর্মীরাও আহত হয়েছেন।
শিক্ষার্থী রাজিউর রহমানকে স্থানীয়রা মারধর করে একতলা ছাদ থেকে ফেলে দেয়। প্রায় চার ঘণ্টা পর তাকে উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে এক শিক্ষার্থীকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে আহত করার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ভাড়া বাসা ও মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলার অভিযোগ উঠেছে।
১৪৪ ধারা জারি : চবির ২ নম্বর গেট বাজার থেকে রেলগেট পর্যন্ত এলাকায় গতকাল দুপুর ২টা থেকে আজ সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮–এর ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এ সময়ে ৫ জনের বেশি একত্রে অবস্থান, সভা–সমাবেশ, বিক্ষোভ, মিছিল, গণজমায়েত ও অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ থাকবে।
পরীক্ষা স্থগিত : পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ায় গতকাল ও আজ সোমবারের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। উপ–উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মমতাজ উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
যৌথবাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতির উন্নতি : ১৪৪ ধারা জারির পর বিকাল ৪টার দিকে ক্যাম্পাসে যৌথবাহিনী (পুলিশ, র্যাব ও সেনা) প্রবেশ করে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানান নিরাপত্তা দপ্তরের সুপারভাইজার নূর উদ্দিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ করেছে। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করা হয়েছে। বয়স্ক লোকেরা পর্যন্ত মেরেছে শিক্ষার্থীদের। আমরা এর বিচার চাই।
স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা ছোট একটা বিষয়কে বড় করেছে। একটা ভাড়া বাসায় ঝামেলা হয়েছে। সেটা সেখানেই সমাধান করা যেত। তারা সেটা না করে স্থানীয় একজনকে মারধর করার জন্য গ্রামে ঢুকে পড়ে। এরপর গ্রামবাসী সেটা মেনে নিতে পারেনি। সব বাসায় একটা নিয়ম থাকে। দেরিতে আসলে ঢুকতে দেয় না। তবু মানুষের ভুল হতে পারে। সেটা সমাধান করাও যেত।
হাটহাজারী প্রতিনিধি জানান, স্থানীয়দের দাবি, সংঘর্ষে তাদের ১০ থেকে ১৫ জন আহত হয়েছেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে হাটহাজারী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু মোহাম্মদ কাওসার হোসেনের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মো. তারেক আজিজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ট্রেনিংয়ে ঢাকায় আছেন বলে জানান।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন গণমাধ্যমকে জানান, বর্তমানে পক্ষসমূহ আক্রমণাত্মক অবস্থায় থাকায় এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, জনসাধারণের জীবন ও সম্পদ রক্ষা ও শান্তি–শৃঙ্খলা স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।