চবির শিক্ষার্থীরা ফিরতে পারছেন না ভাড়া বাসায়, প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী ‘উদ্বাস্তু’

শিক্ষার্থী-স্থানীয় সংঘর্ষ

চবি প্রতিনিধি | শনিবার , ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় গ্রামবাসীর সংঘর্ষের পর কেটে গেছে ছয় দিন। তবুও জোবরা ও ফতেপুর গ্রামের ভাড়া বাসায় ফেরার সাহস পাননি প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী। বহু শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন ধরে মাসিক এক থেকে দুই হাজার টাকায় এসব এলাকায় কটেজ ও ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকট পূরণে এই এলাকাগুলো ছিল তাদের ভরসা। কিন্তু সহিংস রাতের পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। কারও কারও প্রাণ বাঁচাতে এক কাপড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে, অনেকে আবার আতঙ্কে ভাড়া বাসা ছেড়েছেন। এখন তারা যেন ক্যাম্পাসে উদ্বাস্তু।

চবির মোট শিক্ষার্থী প্রায় ২৮ হাজার। এর মধ্যে আবাসিক হলগুলোয় আসন রয়েছে মাত্র সাত হাজারের জন্য। বাকি ২১ হাজার শিক্ষার্থীকে আশপাশের গ্রাম কিংবা চট্টগ্রাম শহরে (২২ কিলোমিটার দূরে) ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। জোবরা ও ফতেপুর গ্রামেই থাকতেন অন্তত তিন হাজার শিক্ষার্থী। সংঘর্ষের পর থেকে তারা এখন কেউ বন্ধুদের হলে গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছেন, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে থাকছেন। পরীক্ষার সময় পড়াশোনার পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে বলেই অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আজিমুল ইসলাম বলেন, ‘শনিবার রাতে বাসার ভেতর আটকা ছিলাম। পরে সেনাবাহিনী ও বন্ধুদের সহায়তায় কোনোমতে ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। এখনও পর্যন্ত নিজের ভাড়া বাসায় ভয়ে যেতে পারছি না। কারণ আমরা এখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। একই রাতে তন্ময় চৌধুরী প্রাণ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি বলেন, এক কাপড়ে বের হয়েছি। বই, খাতা, পোশাক সব পড়ে আছে বাসায়। পরীক্ষা চলছে, কিন্তু পড়াশোনা বা থাকার কোনো ঠিক নেই। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।

আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন বলেন, আসিফ ভিলার বিপরীতে একটি বাসায় আমরা চারজন থাকতাম। শনিবার থেকে রবিবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত ভেতরে আটকা ছিলাম। পরে ক্যাম্পাসে এসে একদিন থাকি, তারপর গ্রামের বাড়ি চলে যাই। এখন ক্যাম্পাসে ফিরতে ভয় হয়। কারণ ওই এলাকা তো আমাদের জন্য এখন নিরাপদ না। কখন আবার এলাকাবাসী আক্রমণ করে সে ভয়ে আছি।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অধ্যাপক ড. ইয়াহইয়া আখতার বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের স্বার্থে জোবরা ও ফতেহপুর গ্রামের মেম্বার চেয়াম্যানসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ডেকে সভা করেছি। সেখানে আমাদের ছাত্র প্রতিনিধিরাও ছিলো। আমি তাদেরকে বলে দিয়েছি আমাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার যেন কোনো সমস্যা না হয় এবং শিক্ষার্থীরা যেন নির্ভয়ে থাকতে পারে সেভাবে আমাদের আলাপ হয়েছে। তবুও কোনো শিক্ষার্থী যদি ভয়ে থাকে বা কোনো সমস্যা থাকে তাহলে তারা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করবে। আশা করি আমরা সুন্দর একটা সমাধান করবো। এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেও তো আর শতভাগ আবাসন করতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৬০ বছরের প্রশাসন যেটা করতে পারেনি আমি কীভাবে একদিনে সেই কাজ করবো? আমার হাতে আলাদিনের ১২টা চেরাগ এনে দিলেও সম্ভব না। তবে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান করতে আমরা সবসময় প্রস্তুত।

সমঝোতা করতে চায় গ্রামবাসী: সংঘর্ষের ঘটনায় সমঝোতা করতে চায় স্থানীয় গ্রামবাসী। জোবরা সমাজ সংস্কার ও উন্নয়ন পরিষদ (জোসউপ) নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে গ্রামবাসী সমঝোতার বিষয়টি জানিয়েছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রাম একত্রে শান্তি ও সংহতির আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জোবরা গ্রামের সমপ্রদায় সামপ্রতিক অশান্তি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। রাতের সংঘর্ষে ছাত্রছাত্রী ও গ্রামবাসী আহত হয়েছেন, সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের প্রস্তাব হলো বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রামের যৌথ সমন্বয় প্ল্যাটফর্ম অভিযোগ ও সমস্যা দ্রুত সমাধান করবে। আমরা বিশ্বাস করি, এই উদ্যোগের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী ও গ্রামবাসী নিরাপদ, সম্মানজনক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে একত্রে বসবাস করতে পারবে।

এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়ের করা মামলার পর থেকে পুরুষরা রাতে গ্রামে অবস্থান করেন না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জোবরা গ্রামের স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, আমাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আগে কখনো বৈরী সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ওই ঘটনার পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। প্রশাসন গ্রামের এক হাজার মানুষকে আসামি করেছে। আমরা কী অপরাধ করেছি বলেন? গ্রামবাসীও এখন ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। মামলার পর থেকে গ্রামে পুরুষরা রাতে বাড়িতে থাকেন না। গ্রেপ্তারের আতঙ্কে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গ্রামবাসী সমঝোতা চায়। আর কোনো সংঘাত চায় না। প্রশাসনসহ কর্তা ব্যক্তিরা বসে সুষ্ঠু একটা সমাধান করুক এমনটা প্রত্যাশা গ্রামবাসীর।

উল্লেখ্য, ৩০ আগস্ট শনিবার রাতে এক ছাত্রীর গায়ে হাত তোলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়, তা ভয়াবহ রূপ নেয়। টানা দুই দিন চলা এই সহিংসতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য, প্রক্টরসহ প্রায় ৫ শতাধিক আহত হন। সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়ের করা মামলায় গত ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর র‌্যাব অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেছে নয়জনকে। গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন, ইমরান হোসেন, হাসান, রাসেল, মো. আলমগীর, নজরুল ইসলাম, মো. জাহেদ, মো. আরমান, দিদারুল আলম ও মো. হান্নান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসড়কের কিনারায় বৈদ্যুতিক খুঁটি, প্রশস্তকরণে বাধা
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু কাল থেকে