কথা কাটাকাটি, একে অপরকে বিদ্রুপ করে কথা বলা, র্যাগ দেওয়া ও শাটলে সিট ধরাসহ বিভিন্ন বিভাগের নানা অনুষ্ঠানে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বার বার সংঘর্ষে জড়াচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ উপ-গ্রুপের নেতাকর্মীরা। এতে একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, অপরদিকে ক্ষতি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের র্যাগ ডে অনুষ্ঠানের কনসার্টে অংশ নেওয়াকে কেন্দ্র করে বিবাদের সূত্রপাত হয় শাখা ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক বিজয় ও সিএফসির মধ্যে। পরে সন্ধ্যার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদ থেকে বিজয় পক্ষের নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দী হলের সামনে এবং সিএফসির অনুসারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলের সামনে অবস্থান নেয়। এ সময় দুপক্ষের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র হাতে অবস্থান করতে দেখা যায়। এরপর কয়েক দফা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন প্রক্টরিয়াল বডি।
গতকাল বুধবার শহীদ আবদুর রব হলের দোকানে বিজয় গ্রুপের এক নেতাকে বাজে আচরণ ও মারধর করে সিএফসির কর্মীরা। তবে সিএফসির দাবি তাকে চাঁদাবাজির জন্য শাসন করা হয়েছে। এরপর ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে সন্ধার পরে আমানত হলে সিএফসি ও সোহরাওয়ার্দী হলে অবস্থান নেয়। এরপর থেমে থেমে সংঘর্ষ চলতেই থাকে। রাত ১০টা পর্য়ন্ত প্রায় ছয় বার ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় সোহরাওয়ার্দী হল ও আমানত হলের মাঝের রাস্তা ইট, পাথর, কাঁচ ও টাইচের টুকরোয় ভরপুর হয়ে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষ চলাকালে বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ছুঁড়াছুঁড়ি করে একে অপরকে। এছাড়া ট্রেনে সিএফসির এক কর্মীকে মারধরের ঘটনায়, স্টেশন চত্বরে অবস্থান নেয় সিএফসি। এ সময়ও উভয় পক্ষকে দেশীয় অস্ত্র হাতে দেখা যায়। দুই হলে প্রায় ১২টি ককটেল বিস্ফোরণ হয়। পরে পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডি অনেক চেষ্টা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। এ সময় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরাও পাথরের আঘাতে আহত হন বলে জানা যায়। রাত সাড়ে বারোটায় এ রিপোর্ট লেখার সময় সোহরাওয়ার্দী ও শাহ আমানত হলে পুলিশের সহায়তায় তল্লাশি চালানো শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
দীর্ঘদিন কমিটি না থাকা, আধিপত্য বিস্তার, প্রশাসনের বিচারহীনতা এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এমন সংঘর্ষ লেগেই আছে বলে মনে করেন বিভিন্ন উপ-গ্রুপের নেতারা। তবে শাখা সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের দাবি এটার সাথে পূর্ণাঙ্গ কমিটির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যারা সংঘর্ষ করছে তারাই ক্যাম্পাসে ফ্রিতে খায় এবং চাঁদাবাজি করে। এছাড়া জামায়াত-শিবিরের অনুপ্রবেশকারী চক্র এখনো যড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে দাবি সভাপতির।
রেড সিগনাল উপ-গ্রুপের নেতা রকিবুল হাসান দিনার বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্তরা চাইলেই পারে কমিটি করতে। পরিচয় থাকলে তার বিরুদ্ধে সহজেই ব্যবস্থা নেয়া যায়। আর অনেকেই বয়স বেড়ে যাওয়ায় হতাশায় রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের রাজনীতি দুই মেরুকরণে বিভক্ত। একটি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাসির নসির উদ্দিন ও অপরটি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী। এই দুইটি গ্রুপ আবার ১১টি উপ-গ্রুপে বিভক্ত। নানা সময় সংঘাতের কারণে কমিটি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এ শাখার নেতাকর্মীরা। গত পাঁচবছরে এ শাখার কমিটি হয়েছে মাত্র দুইবার। ২০১৫ সালের ২০ জুলাই আলমগীর হোসেন টিপু সভাপতি এবং এইচ এম ফজলে রাব্বি সুজনকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি হয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘাতের কারণে দুই দফা স্থগিতের পর ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর কমিটি বিলুপ্ত করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এরপর দেড় বছরেরও বেশি সময় পর ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই রেজাউল হক রুবেল সভাপতি এবং ইকবাল হোসেন টিপুকে সাধারণ সম্পাদক করে দুই সদস্য করে কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার কথা থাকলেও প্রায় তিন বছরেও পূর্ণাঙ্গ হয়নি কমিটি। এতে বাড়ছে হতাশা, ক্ষোভ আর দায়িত্বহীনতা। যার থেকেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়াচ্ছে বলে মনে করছেন উপ-গ্রুপগুলোর নেতারা। এ পর্যন্ত কয়েক দফা পূর্ণাঙ্গ ও হল-অনুষদ কমিটির লক্ষে জীবনবৃত্তান্ত ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ থেকে প্রত্যয়পত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি।
এদিকে শাখা সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, এ ঘটনার সাথে পূর্ণাঙ্গ কমিটির কোনো সম্পৃক্ততা নাই। পূর্ণাঙ্গ কমিটির ব্যাপারে তিনি বলেন, এই মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে। এ ব্যাপারে সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুকে কল করে পাওয়া যায়নি।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভুঁইয়া আজাদীকে বলেন, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটার পর থেকেই আমরা ঘটনাস্থলে অবস্থান করছি। ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন আছে। রাত সাড়ে বারোটা থেকে সোহরাওয়ার্দী ও আমানত হলে তল্লাশি শুরু হয়েছে।