আমাদের বাস্তুতন্ত্র থেকে চড়ুইর মতো একটি পাখির বিলুপ্তির কারণে মানুষের জীবনে নেমে আসতে পারে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। চীনে মানব ইতিহাসের এক মহাদুর্ভিক্ষের জন্য ১৯৫৮ সালে শুরু হওয়া চার বছরব্যাপী ‘গ্রেট স্পারো ক্যাম্পেইন’ নামে পরিচিত চড়ুই নিধন অভিযানকে দায়ী করা হয়। ওই দুর্ভিক্ষে সরকারি হিসাবে দেড় কোটি মানুষ মারা যায়। অন্যান্য সূত্রমতে এ সংখ্যা সাড়ে ৩ কোটি থেকে ৭ কোটি ৮০ লাখ।
আমাদের বাস্তুতন্ত্রে চড়ুইয়ের মতো পাখির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ২০ মার্চ বিশ্ব চড়ুই দিবস পালিত হয়। এই দিনটি চড়ুইসহ বিভিন্ন পাখির ভবিষ্যৎ বিলুপ্তি রোধে মানুষকে পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করে। ২০২৪ সালের বিশ্ব চড়ুই দিবসের প্রতিপাদ্য ‘চড়ুইকে কিচির–মিচির করার সুযোগ দিন’, ‘আমি চড়ুই ভালোবাসি’ এবং ‘আমরা চড়ুই ভালোবাসি’। ২০১০ সালের ২০ মার্চ থেকে বিশ্ব চড়ুই দিবসের সূচনা হয়। ভারতের প্রকৃতি সংরক্ষণবাদী এবং নেচার ফরএভার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ দিলাওয়ার ২০ মার্চ বিশ্ব চড়ুই দিবস উদযাপনের উদ্যোগ নেন। পরে ফ্রান্সের ইকো–সিস অ্যাকশন ফাউন্ডেশনও এতে যোগ দেয়। টাইম ম্যাগাজিন ২০০৮–এর জন্য মোহাম্মদ দিলাওয়ারকে ‘পরিবেশের হিরো’ হিসেবে মনোনীত করে।
চীনে চড়ুই হত্যার ইতিহাস ও পরিবেশগত বিপর্যয়: মাও সেতুং ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর আধুনিক গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। চীনে জীবনকে আধুনিকীকরণ ও উন্নত করার প্রয়াসে বেশ কিছু ব্যাপক প্রচারণা চালান মাও সেতুং। ‘দ্য ফোর পেস্ট ক্যাম্পেইন’ ছিল এই ড্রাইভগুলির মধ্যে একটি। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল ছিল ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের’ বছর। মশা, মাছি ও ইঁদুর ছাড়াও সকল চড়ুই হত্যা করাই ছিল এই অভিযানের অংশ। তবে চড়ুই হত্যা শুরু হওয়ার পরের বছর থেকে চীনে একটি নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়। বেড়ে যায় ফসলের জমিতে পোকামাকড়ের উপদ্রব। পঙ্গপালের আক্রমণে অধিকাংশ গ্রামীণ এলাকায় শস্য উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, শুরু হয় ব্যাপক দুর্ভিক্ষ।
ধারণা করা হয়, ১৯৫৮ সালে শুরু হওয়া চড়ুই নিধন অভিযানে প্রতি জন মানুষ যদি একটি করেও চড়ুই হত্যা করে; তবে সেই অভিযানে অন্তত ৬০ কোটি চড়ুই হত্যা করা হয়েছে। অভিযান চলাকালে পাখিদের ভয় দেখানোর জন্য নিরন্তর ড্রাম বাজানো হত, যতক্ষণ না পাখি ক্লান্ত হয়ে মারা না যায়। চীনের সেই অভিযান এবং দুর্ভিক্ষ নিয়ে চীনের সাংবাদিক ইয়াং জিশেং ‘টম্বস্টোন’ নামে একটি বই লিখেছেন। যেখানে তিনি ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করেন।
বিজ্ঞানীরা জানান, পঙ্গপালের মতো কীটপতঙ্গের প্রধান শিকারী হল চড়ুই পাখি। চড়ুই নিধন অভিযানের পরে পঙ্গপালের দল তাদের প্রধান শিকারীকে না পেয়ে ব্যাপকভাবে বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম হয়েছিল। যে কারণে এসব পঙ্গপাল সামনে যা পেয়েছে বিনাবাধায় তাই সাবাড় করেছে। চড়ুই হত্যার পরিণতি এভাবে ভোগ করেছিল চীনের জনগণ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, চড়ুুই পাখি অনেক সাধারণ পাখির প্রতিনিধিত্ব করে। যে কারণে এক অর্থে তাদের দূতও বলা হয়। এর আবাসস্থল সংরক্ষণ অনেক সাধারণ জীববৈচিত্র্যকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এই পাখিটির শহুরে এবং গ্রামীণ উভয় আবাসস্থলই অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে। পরিবেশে এই হাউস স্পারো বা চড়ুই পাখির কমে যাওয়ার ঘটনা আমাদের চারপাশের পরিবেশ যে ক্রমাগত অবক্ষয়ের সম্মুখীন হচ্ছে, তার একটি সূচক। তিনি বলেন, এটি একটি সতর্কতা ঘণ্টাও। যা আমাদের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার উপর সম্ভাব্য ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. আশরাফ আলী ছিদ্দিকী বলেন, চড়ুই পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে মানুষসহ অন্যান্য জীবনের উপর এর কী কী ক্ষতি করছে, তা আমাদের জানতে হবে। যাতে আমরা এর প্রভাব অনুমান করতে পারি এবং এসব প্রাণকে ভালবাসতে পারি।