চট্টল শার্দুল এম এ আজিজ।

নাসিরুদ্দিন চৌধূরী | শুক্রবার , ১০ জানুয়ারি, ২০২৫ at ১০:০৮ পূর্বাহ্ণ

তিনি আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক, সত্তরে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য বা এমএনএ ছিলেন; এমনি আরো নানা পরিচয়ে তাঁকে উপস্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু তিনি যে ‘এক দফার নামে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন, সেটাই তাঁর সব পরিচয় ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠা উচিত। আওয়ামী লীগ বা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ তাঁর কাছে যত ঋণী, আমাদের স্বাধীনতা এমনকি বাংলাদেশও তাঁর কাছে অনেকখানি ঋণী। তিনিই প্রথম স্বাধীনতার কথা বলতে শুরু করেছিলেন। একাত্তরের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক জনসভায় বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি করে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। কিন্তু তারও বহু আগে, ৬৯ সালে চট্টগ্রামে স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয় জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজের কণ্ঠে। তিনি সে বছর সীতাকুণ্ডের এক জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন, ‘ছয় দফা আদায় না হলে এক দফা। তখন দেশে সামরিক শাসন চলছিলো। এবং উক্ত ঘোষণার জন্য সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ এম এ আজিজকে আটক করেছিলেন।

অবশ্য তিনি সরাসরি স্বাধীনতার কথা বলেন নি এবং ‘স্বাধীনতাশব্দও উচ্চারণ করেন নি। কিন্তু এক দফার মাধ্যমে তিনি যে স্বাধীনতার কথাই বুঝিয়েছেন, সেটা বুঝে নিতে কারো অসুবিধা হয় নি। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সাংবাদিক মঈনুল আলম, যিনি দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে দৈনিক ইত্তেফাকএ কাজ করছেন, তাঁর পিতা সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম এবং কনজিউমার ইকনমিস্ট নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৯০ সালের ১৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় “স্মিত হাসির পেছনে কঠিন সংকল্পশীর্ষনামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে যথার্থই লিখেছেন, “বস্তুত স্বাধিকার আন্দোলনের চিন্তাধারায় চট্টগ্রাম সর্বজনীনভাবে সারা প্রদেশ থেকে (রাজধানী ঢাকা অপেক্ষাও) এগিয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনামলেই জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ সীতাকুণ্ডের এক জনসভায় ‘ছয় দফা আদায় না হলে এক দফাঘোষণা দিতে পেরেছিলেন (এ ঘোষণার জন্য সামরিক শাসক কর্তৃপক্ষ এম এ আজিজকে আটক করেন) আমি যতদূর জানি সে ঘোষণাই ছিল কোন আওয়ামী লীগ নেতার প্রথম জনসমক্ষে উচ্চারিত স্বাধীনতার ডাক। ”

৬৯ সালে মিরসরাই থানা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় এম এ আজিজ অনুরূপ ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, “সরকার ৬ দফা মেনে না নিলে জনগণ ১ দফার তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম আরম্ভ করবে।” এবার আর রাখডাক নয়, স্বাধীনতার কথা সরাসরিই বলে ফেললেন তিনি। এই ঘোষণার জন্যও তাঁকে গ্রেপ্তার করে আটকাদেশ দেয়া হয়েছিলো। ১৯৭০ সালে কাট্টলীর এক জনসভায় তিনি আবার ঘোষণা করেন ‘যদি ৬ দফা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে আমরা এক দফার আন্দোলন করবই।এভাবে তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের কথা প্রকাশ্যে সভাসমাবেশে বলতে শুরু করেছিলেন।

এক দফার প্রবক্তা হিসেবে তিনি ৬৯এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কাছে অতি প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ডাকসু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হল বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতেও তিনি ছাত্রদের দ্বারা সংবর্ধিত হয়েছিলেন। ঢাকায় ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিনে উষ্ণ সংবর্ধনায় সিক্ত হতে হতেও চট্টল শার্দুল এমএ আজিজ রুদ্র মূর্তিতে উচ্চারণ করেছিলেন আরো ভয়ংকর বোমা : If you (Pakistani Junta) have the right to exceed. We shall have the right to secede.’ এটি ছিলোঁ একটি দুঃসাহসী বক্তব্য; এতে স্পষ্টতই বিচ্ছিন্নতার হুমকি ছিলো।

এম এ আজিজ ষাটের দশকের মাঝামাঝি ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রকামীদের বিকশিত হতে সাহায্য করেন। এ বিষয়ে কাজী আরেফ আহমদ প্রথম আলোচনার সূত্রপাত করেন। তিনি লিখেছেন : “১৯৬৪ সালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদে তিন সদস্য বিশিষ্ট কাঠামো সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমিসহ কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস গঠিত হয়।” এরপর স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস চট্টগ্রাম শাখা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন : “জেলা ফোরামের দেখাশোনা করতেন আবুল কালাম আজাদ। এটা আজাদ, আবু সালেহ, মোক্তার আহমদ, সাবের আহমদ আসগরী ও এস এম ইউসুফকে নিয়ে গঠিত হয়। পরে এস এম ইউসুফ বিপ্লবী পরিষদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এই ফোরামের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও চট্টগ্রাম শহরে কাজের জন্য আজাদের দায়িত্বে আরো একটি ফোরাম গঠিত হয়। সেখানে ডা. মাহফুজুর রহমান, জাকারিয়া, ডা. গোফরান, আবুল কাসেম ও রাখাল চন্দ্র বণিককে দিয়ে ফোরামটি চালু হয়। এদের ছায়া হিসেবে ছিলেন এম এ আজিজ”। সত্তরের নির্বাচনের পর লালদীঘির ময়দানে সংবর্ধনা সভায় ১৯৭১ সালের পহেলা জানুয়ারি এম এ আজিজ বললেন, “আমি বাতাসে বারুদের গন্ধ পাচ্ছি। সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। আর ছয় দফা নয়। এখন এক দফার আন্দোলন শুরু হবে।” তিনি আরো বললেন, “জনগণ ভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানকে দুভাগ করে দিয়েছে”।

১৯৭০ সালের জুলাই মাসে কৃষকদের খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে সরকার ক্রোক জারি করলে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। সরকারও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেফতার করতে থাকে এবং অসংখ্য কর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। মিরসরাইয়ে ফজলুল হক বিএসসিসহ ৬/৭ জনের বিরুদ্ধে, সাতকানিয়াতে তৈয়বুর বশীরসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে, রাঙ্গুনিয়া কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতিসম্পাদকসহ ১৮ জন, পটিয়া থানা ছাত্রলীগ কর্মী শামসুদ্দীনসহ ৫/৬ জন এভাবে মোট ৪৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এর প্রতিবাদে ১ জুলাই মিরসরাইয়ে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জনসভা হয়। প্রধান অতিথির ভাষণে এম এ আজিজ সরকারি আচরণের তীব্র নিন্দা করেন। ৬ দফার প্রশ্নে তিনি বলেন, “৬ দফা আদায় না হলে জনগণ এক দফার আন্দোলন বেছে নিতে বাধ্য হবে।” এই বক্তব্যের পর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭০ সালের ১৫ মে লালদিঘির ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের উপস্থিতিতে তিনি এক দফার কথা ঘোষণা করেন। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, “৬ দফা গ্রহণ করা না হলে দেশ বিভক্ত হয়ে যাবে। তখন মাত্র এক দফার আন্দোলনই শুরু করা হবে।”

এম. . আজিজ ১৯২১ সালে চট্টগ্রামের হালিশহরে এই মহান নেতা জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা মহব্বত আলী সরকার এবং মাতা রহিমা খাতুন।

রাজনীতিতে তিনি তাঁর নেতৃত্বের গুণেই মহিমান্বিত ছিলেন। বিভাগপূর্ব সময়ে এম.. আজিজ পাকিস্তান আন্দোলনে তরুণ নেতা ও সংগঠক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পরে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল গ্রুপ আবুল হাশিমসোহরাওয়ার্দী গ্রুপে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল প্রখর। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা লগ্নে ঐ দলে যোগদান করেন। ১৯৪৯ সালে এম.. আজিজ চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এই জন্য ‘২১ ফেব্রুয়ারি’ পরবর্তী সময়ে তিনি বহুবার গ্রেফতার হন। ১৯৫৪ সালে ২১ দফা আন্দোলনের যৌক্তিকতা মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন। এজন্য গ্রেফতার হন।

১৯৫৬ সালে তিনি যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। ঐ বছর তিনি ডবলমুরিংসীতাকুণ্ড এলাকা থেকে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভায় দল পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে এম.. আজিজের ভূমিকা ছিল সবচাইতে বেশি। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভায় পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব পাশ করিয়ে ঐ প্রস্তাবের কপি বিভিন্ন জেলা কমিটির কাছে পাঠান এবং তাঁদের মতামত চেয়ে ফিরতি খামও পাঠান। বিভিন্ন জেলা পুনরুজ্জীবনের পক্ষে মত দিলে তাদের মতামত নিয়ে এম.. আজিজ প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি সম্মিলিত বিরোধী দলের আহবায়ক ছিলেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ৬ দফা ঘোষণা করলে তাঁকে সমর্থন করে প্রথম বিবৃতি দেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম.. আজিজ ও তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। ৬ দফার পূর্ণাঙ্গ পুস্তিকাও প্রকাশ করেন প্রথম তিনি।

১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বানে মুজিব দিবস ও হরতাল পালিত হয়। এদিন লালদীঘি ময়দানে লাখো লোকের জনসভায় সভাপতির ভাষণে এম.. আজিজ লালদীঘি ময়দানের নাম পরিবর্তন করে মুজিব পার্কঘোষণা করেন। ৬০এর দশকের শেষ দিকে এম.. আজিজের চিন্তাধারায় সমাজতন্ত্রের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। চট্টগ্রামে গণঅভ্যুত্থানের নায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালের ১৮ জুলাই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিলে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৭০ সালে তাঁর গ্রেফতারের বিরুদ্ধে সারা বাংলাদেশে বিরাট আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং ২৭ জুলাই আজিজ দিবস পালন করা হয় । ১৫ আগস্ট তিনি মুক্তি পান।

১৯৭০ সালে এম.. আজিজ আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন। ঐ বছর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তিনি এম.এন.. (জাতীয় পরিষদের সদস্য) নির্বাচিত হন। এম.. আজিজ দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাবান নেতা ছিলেন। এ কারণে চট্টগ্রামের বাইরে দেশ জুড়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তাই এ মহান নেতার অবদান চট্টগ্রামবাসীর কাছে এক অবিস্মরণীয় গৌরবগাথা। চট্টগ্রাম এম..আজিজ স্টেডিয়াম তাঁর নামেই নামকরণ করা হয় ।

এম.. আজিজ ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি বহদ্দারহাট ফটিকছড়িতে জীবনের শেষ জনসভায় ভাষণ প্রদান করেন। ১১ জানুয়ারি রাত একটায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পরলোকগমন করেন।

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংংস্কৃতিক সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআগস্ট বিপ্লবের অর্জনকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না
পরবর্তী নিবন্ধজু’ম আর খুতবা