১৯৬৯ থেকে ১৯৭১-এর ১০ জানুয়ারি-এই সময়টা ছিলো এম এ আজিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ফুলে ও ফসলে সাফল্যের ডালা ভরে উঠেছিলো তাঁর। যখন তিনি জনপ্রিয়তায় হিমালয়ের চূড়ায় অবস্থান করছেন, তখনই প্রভু তাঁকে ইহলোক থেকে তুলে নিয়ে গেলেন পরলোকে। হায় ঈশ্বর কী ছিলো তোমার মনে ! সেদিনও তিনি ব্যস্ততম সময় কাটিয়েছিলেন। মনসুর ভাই’র (মির্জা মনসুর এমপিএ) দাওয়াত রক্ষা করতে ফটিকছড়িতে যান, সেখানে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন; তারপর শহরে ফিরে আসার পথে বহদ্দারহাটে জীবনের সর্বশেষ জনসভায় বক্তৃতা করে দেওয়ানজী পুকুর পাড়ের বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়তে না পড়তেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চির নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েন। এমএ আজিজ জন্মের শতবর্ষে পদার্পণ করলেন চলতি সালে; আজ থেকে ১০০ বছর পূর্বে ১৯২১ সালে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ প্রান্তীয় জেলা চট্টগ্রামের বঙ্গোপসাগর উপকূল হালিশহরে জন্মেছিলেন তিনি। অনেক ঘটনার ঘনঘটায় এটি একটি অবিস্মরণীয় বছর-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ “মুজিব বর্ষ” উদযাপন করছে জাতি, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও এসে গেল ঢাকঢোল পিটিয়ে এবং এমএ আজিজের জন্মশতবার্ষিকী-এই ত্রিবিধ মনিকাঞ্চন যোগে অমরত্বের মহিমা অর্জন করলো দুই হাজার একুশ খ্রিস্টাব্দ।
বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এমএ আজিজ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন এবং সর্বপ্রথম অমিত বিক্রমে “৬ দফা না মানলে ১ দফা” এই সাহসী উচ্চারণের মাধ্যমে স্পষ্টতই জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকেই মূর্ত করে তুলেছিলেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর পরে স্বাধীনতায় যদি অন্য কারো অবদান অনুসন্ধান করতে হয়, তাহলে দেখা যাবে সেখানে এমএ আজিজের নামই জ্বলজ্বল করছে।
স্বাধীনতা যদি এম এ আজিজের প্রথম অবদান হয়, তাহলে তাঁর দ্বিতীয় অবদান হলো তিনি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের দেড়শতাধিক বছরের (১৮৭৫-২০২০) রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক মহান নেতার নাম খুঁজে পাওয়া যাবে।
দশ-বিশ-ত্রিশ দশকের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী রাজনীতিকে চল্লিশের দশকে ফজলুল কাদের চৌধুরী এসে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান আন্দোলনে বিপথগামী করে ফেলেছিলেন। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে মাদার্শায় হালদা নদীর টেক কাটা আন্দোলনের নেতৃত্বদান থেকে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এমএ আজিজ যুগের আরম্ভ। তারপর একে একে মূলনীতি বিরোধী আন্দোলন, টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচন, রোজগার্ডেন সম্মেলনে যোগদান করে আওয়ামী লীগ গঠনে ভূমিকা গ্রহণ এবং বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলনের অগ্রভাগে এমএ আজিজকে প্রত্যক্ষ করে চট্টগ্রামের মানুষ একজন নতুন নেতার আবির্ভাবে সচকিত হয়ে ওঠে। তারও আগে ১৯৪৯ চট্টগ্রামে যখন প্রথম এম এ আজিজের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়, তখনই চট্টগ্রামে যে একজন নতুন নেতার অভিষেক ঘটতে যাচ্ছে, তারই প্রথম প্রকাশ ঘটেছিলো। শুভপুর থেকে টেকনাফ, তিন পার্বত্য জেলা, এমনকি চট্টগ্রাম শহরও নিয়ে গোটা চট্টগ্রামে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী লীগের একটিই কমিটি গঠিত হয়েছিলো, এমএ আজিজই যার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তী বছর শহরের জন্য আলাদা কমিটি হলে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্ব পরিস্ফূট হয়ে ওঠে।
ঢাকায় যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগই ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলো এবং যার কারণে সেটা সম্ভব হয়েছিলো, তিনি হচ্ছেন এমএ আজিজ। তিনি তখন অবিভক্ত চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য যে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিলো, তার নেতৃত্ব নিয়ে দু’ধরনের মত প্রচলিত আছে। একটি মতে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী এবং আহবায়ক এম এ আজিজ ও চৌধুরী হারুনুর রশিদ যুগ্ম আহবায়ক; অপর মতানুসারে এমএ আজিজ আহবায়ক এবং মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও চৌধুরী হারুনুর রশিদ যুগ্ম আহবায়ক।
ভাষা আন্দোলনে রক্ত ঝরলো বটে, কিন্তু তাতে বাংলা ভাষারই জয় হলো। রফিক, জব্বার বরকত, সালামের রক্তে ভেজা ঢাকার রাজপথে উন্মেষ ঘটলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের, পরাজিত হলো ইসলামী জাতীয়তা ও পাকিস্তানি ভাবধারা বাঙালি জাতীয়তাকে মর্মে ধারণ করে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্ষেত্র উন্মোচিত হলো। এম এ আজিজ এই অসাম্প্রদায়িক ধারার নতুন রাজনীতির মানুষকে আহবান জানালে প্রান্তরে। অবশ্য জহুর আহমদ চৌধুরীও একই রাজনীতির বিস্তৃত প্রান্তরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনিও বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ছিলেন এবং চল্লিশের দশক থেকে এমএ আজিজের সঙ্গে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। মাদার্শায় কৃষকদের হালদার টেক কাটা আন্দোলন, টাঙ্গাইল উপ নির্বাচন, মূলনীতি বিরোধী আন্দোলন, ঢাকায় রোজ গার্ডেন হলরুমে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে যোগদান, চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ গঠন এবং ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করেন। চট্টগ্রামে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি গড়ে তোলার জন্য তাঁর অবদানও কম নয়। কিন্তু তিনি ছিলেন উদার ও সমন্বয়ধর্মী রাজনীতিক। পক্ষান্তরে এমএ আজিজ দুর্জয় সাহসে, কর্মনিষ্ঠায়, সংকল্পের অনমনীয় দৃঢ়তায়, প্রতিজ্ঞায় অটল, আদর্শে অবিচল, সংগ্রামে আপসহীন এক বিরল নেতা। কাজেম আলী মাস্টার মওলানা ইসলামাবাদী- দেশপ্রিয় এবং মাস্টারদাকে বাদ দিলে এমন নেতা চট্টগ্রামের ইতিহাসে আর একজনও পাওয়া যাবে না। একারণে জহুর আহমদ চৌধুরীর চেয়ে এমএ আজিজ এগিয়ে থাকবেন।
চট্টগ্রামে ৭০-এর নির্বাচন ছিলো এমএ আজিজের শো। চট্টগ্রাম থেকে একমাত্র তিনিই আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। মনোনয়ন চূড়ান্ত করার সময় এমএ আজিজ জেলে থাকায় বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম এসে জেলখানায় এমএ আজিজের সঙ্গে দেখা করে তাঁর মতামত নিয়ে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। এমএ আজিজকে জাতীয় পরিষদে এমএনএ মনোনয়ন দেয়া হয়। জহুর আহমদ চৌধুরী পান এমপিএ অর্থ প্রাদেশিক পরিষদের মনোনয়ন। স্পষ্টই এই মনোনয়ন এমএ আজিজের প্রাধান্য ঘোষিত হয়। এতে ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ ছাত্রনেতা এসএম ইউসুফ লালদিঘিতে জনসভা করে এই মনোনয়নের প্রতিবাদ করেন এবং মন্তব্য করেন যে “আওয়ামী লীগে নীলবর্ণ শৃগালের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।” কিন্তু এমএ আজিজের কথা অনুযায়ী মনোনয়নে আওয়ামী লীগের ক্ষতি হয় নি, লাভই হয়েছে। মুসলিম লীগের জাঁদরেল নেতাদের পুত্রদের মনোনয়ন দিয়ে এমএ আজিজ চেয়েছিলেন মুসলিম লীগের ঘরে ভাঙন ধরাতে। মোশাররফ হোসেনের পিতা সৈয়দুর রহমান, মির্জা মনসুরের পিতা মির্জা আবু আহমদ, কায়সারের পিতা ক্যাপ্টেন এয়ার আলী খান পেঁচু মিয়া, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পিতা আহমদ কবির চৌধুরী এরা প্রত্যেকেই মুসলিম লীগের ডাকসাইটে নেতা। তাদের পুত্রদের আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেয়ার তারা দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং ফজলুল কাদের চৌধুরীর দক্ষিণ হস্ত ভেঙে গিয়েছিলো। তাঁর প্রস্তাবিত প্রার্থীরা প্রত্যেকেই নির্বাচনে বিজয়ী হন এবং জীবিতরা এখনো আওয়ামী লীগই করছেন, মৃতরাও আজীবন আওয়ামী লীগই করেছেন-কখনো দল ত্যাগ করেন নি।
এমএ আজিজ একমাত্র নেতা যাঁকে নির্বাচনে বিজয়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়ে ডাকসু সংবর্ধনা করেন। প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করার পর থেকে এমএ আজিজ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকেন। ৬ দফার পক্ষে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র এমএ আজিজই চট্টগ্রাম থেকে সর্ব প্রথম ৬ দফা সমর্থন করে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করেন। তখনো ৬ দফা প্রকাশ্যে ঘোষিত হয়নি। ৬৬’র ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে কপ-এর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ৬ দফা পেশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর চট্টগ্রাম থেকে ৬ দফাকে সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান করা হয় ১৩ ফেব্রুয়ারি। তাঁর সঙ্গে আরো চারজন বিবৃতিতে সই করেন। তাঁরা হলেন আবুল কাশেম সাবজজ, আবদুল্লাহ আল হারুন, এমএ হান্নান ও একে এম আবদুল মন্নান।
আগরতলা মামলার খরচ চালানোর জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এমএ আজিজ ‘মুজিব ফান্ড’ গঠন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য ‘মুজিব দিবস’ পালন করেছিলেন। ৬ দফাকে বানচাল করার জন্য পিডিএম ৮ দফা দিয়ে যে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলো, তা’ এ এমএ আজিজের দৃঢ়তার কারণেই প্রতিহত করার সম্ভবত হয়েছিলো। সবশেষে সেই কথাটি বলতে হবে, যাকে বলা যেতে পারে এমএ আজিজের রাজনীতির নির্যাস। এক দফা-এই দুটি শব্দ দিয়ে এমএ আজিজের রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনামলেই এম এ আজিজ প্রথম সীতাকুণ্ডের এক জনসভায় ‘ছয় দফা আদায় না হলে এক দফা’ ঘোষণা দিয়েছিলেন (এ ঘোষণার জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষ এম এ আজিজকে আটক করেন।) ৬৯ সালে মিরসরাই থানা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় এম এ আজিজ অনুরূপ ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, “সরকার ৬ দফা মেনে না নিলে জনগণ ১ দফার তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম আরম্ভ করবে।’’ এবার আর রাখডাক নয়, স্বাধীনতার কথা সরাসরিই বলে ফেললেন তিনি। এই ঘোষণার জন্যও তাঁকে গ্রেপ্তার করে আটকাদেশ দেয়া হয়েছিলো। ১৯৭০ সালে কাট্টলীর এক জনসভায় তিনি আবার ঘোষণা করেন ‘যদি ৬ দফা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে আমরা এক দফার আন্দোলন করবই।’ এভাবে তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের কথা প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে বলতে শুরু করেছিলেন। সত্তরের প্রথমভাগে কঙবাজার পাবলিক হলে এক কর্মী সম্মেলনে তিনি কর্মীদের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন ‘সরকার যদি ৬ দফা না মানে তাহলে কি করবেন? জবাবের জন্য সামান্য একটু প্রতীক্ষা, তারপর দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সুস্থির ঘোষণা হয় ‘ছয় দফা না মানলে এক দফার আন্দোলন শুরু হবে।’
ঢাকায় ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিনে উষ্ণ সংবর্ধনায় সিক্ত হতে হতেও চট্টল শার্দুল এমএ আজিজ রুদ্র মূর্তিতে উচ্চারণ করেছিলেন আরো ভয়ংকর বোমা : ‘ওভ ুড়ঁ (চধশরংঃধহর ঔঁহঃধ) যধাব ঃযব ৎরমযঃ ঃড় বীপববফ, বি ংযধষষ যধাব ঃযব ৎরমযঃ ঃড় ংবপবফব.’ এটি ছিলো একটি দুঃসাহসী বক্তব্য; এতে স্পষ্টতই বিচ্ছিন্নতার হুমকি ছিলো।
বর্তমানে আমরা চট্টগ্রামে যে আওয়ামী লীগ সংগঠন দেখি, সে সংগঠন এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর অবদান। তাঁরা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের পিতা। শুধু চট্টগ্রাম নয়, তাঁরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আওয়ামী লীগ এখন দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং রুলিং পার্টি। অথচ দলের নেতাদের জন্মশতবার্ষিকী যে চলে যাচ্ছে সেদিকে কারো খেয়াল নেই।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠক