চট্টলায় ছাতিম-জড়ানো হেমন্ত সন্ধ্যা

রুখসানা মিলি | বুধবার , ২২ অক্টোবর, ২০২৫ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

কার্তিকের দুপুরতবু রোদে দারুণ তেজ। পেশাগত কাজে চট্টগ্রামে যাওয়া। জামালখানের ব্যস্ত সড়ক ধরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। হঠাৎ দেখা পেলাম এক পূর্ণযৌবণা রূপবতীরফুলে ফুলে উল্লাসিত ছাতিম গাছটার। দুপুর তাই কেবল শুভ্র ছাতিমের সৌন্দর্যে সন্তুষ্ট থাকতে হলো, মাতাল সৌরভের ছোঁয়া তখন পাওয়া গেল না।

একটি গুচ্ছে সাতটি পাতায় সাজানো ফুল ছাতিমের আরেক নাম সপ্তপর্ণা। ছাতিমগাছের সঙ্গে শয়তানের যোগসূত্র আছে এমন রটনা থাকার দরুণ এর আরেক নাম ডেভিলস ট্রি। অবশ্য ছাতিম কাঠ থেকে ব্ল্যাকবোর্ড হত দেখে ব্ল্যাকবোর্ড ট্রিও বলা হয়। ধারণা করা হয় শয়তান (ডেভিল) শব্দটি অঞ্চলভেদে বিকৃত হয়ে ছয়তাইন্যা, ছাতিয়ান, ছাইত্তান, ছাইত্তান্না থেকে ছাতিম হয়েছে। তবে, সপ্তপর্ণর সাতটা পাতা মিলে ছাতার আকার ধারণ করে থাকে বলেই গাছটির নাম ছাতিম এ মতবাদও প্রচলিত।

প্রতি হেমন্তে ইট কাঠের নগরীতেও তার সুতীব্র সুগন্ধে উপস্থিতি জানান দিয়ে যায়। প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা ছাতিমকে বলেছিলেন, ‘হেমন্তের অঙ্গনে দাঁড়িয়ে দুরন্ত শীতকে অভ্যর্থনা জানানো একমাত্র তরু।’ তাঁর ভাষায়, ‘প্রস্ফুটনের এমন অবারিত উচ্ছ্বাস, ফুলের অক্লান্ত নির্ঝর এবং দূরবাহী প্রবল উগ্র গন্ধের ঐশ্বর্য আর কোনো হৈমন্তী তরুরই নেই।’ ঢাকার ব্যস্ত ছুটে চলা জীবনে ছাতিমের এই সন্ধ্যাগুলো আমাকে মাতিয়ে যায়। নেই নেই করে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় ছাতিমের সুবাস জানান দিয়ে যায় ছাতিম আছে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাড়ি ফেরার পথে ছাতিমের সুগন্ধে মন মাতোয়ারা করে ঘরে ফিরি। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের কল্যাণে আরো অনেক ছাতিম প্রেমীর মাতোয়ারা সন্ধ্যার গল্প চোখে পড়ে।

ঢাকার ছাতিমদের সাথে আমার সম্পর্ক বহু পুরোনো হলেও চট্টগ্রামের ছাতিমদের সম্পর্কে জানা ছিল না। সেদিন সন্ধ্যায় সব কাজ শেষে গেলাম প্রেসক্লাব ভবনের বইয়ের স্বর্গরাজ্য বাতিঘরে। জামালখান রোডে ঢুকতেই ছাতিমের সুবাসে মন মেতে উঠল। বাতিঘরে গিয়ে দেখা হলো বাতিঘরের কাণ্ডারী দীপংকর দাশের সাথে। বই নিয়ে আলাপের পর ক্ষণিক আড্ডার কেন্দ্র হয়ে উঠলো ছাতিম। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের ঠিক সামনে দাঁড়ানো ছাতিম তলায় দলবেঁধে আড্ডা জমলো আরো কিছুক্ষণ। হেমন্তের মৃদু বাতাসে আমাদের ছাতিম সন্ধ্যাটা আরো প্রলম্বিত হয়ে উঠলো। জামালখান রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে আরো এক ছাতিম সুন্দরীর দেখা মিললো। পুরো ছাতিম তলাটা ফুলে ফুলে বিছানো। গাছে দুষ্টু বাদুড় হঠাৎ হঠাৎ একটা করে ছাতিমগুচ্ছ কেটে নিচে ফেলছে। ছাতিম তলায় দাঁড়িয়ে হাতের মুঠোয় এই ফুলের শুভ্রতায় মন একই সাথে প্রসন্ন ও বিষন্ন হয়ে উঠলো। রবীন্দ্রনাথ ছাতিম গাছে বাদুড়ের উপস্থিতি নিয়ে লিখেছিলেন। ছাতিম নিয়ে বিশ্বকবির আবেগের বহু নজির মেলে। তিনি লিখেছিলেন, ‘ওই যে ছাতিম গাছের মতোই আছি/ সহজ প্রাণের আবেগ নিয়ে মাটির কাছাকাছি,/ ওর যেমন এই পাতার কাঁপন, যেমন শ্যামলতা,/ তেমনি জাগে ছন্দে আমার আজকে দিনের সামান্য এই কথা।’

এমনকি ইন্দিরা দেবীকে একটি চিঠিতে নিজের শ্রাদ্ধ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার শ্রাদ্ধ যেন ছাতিম গাছের তলায় বিনা আড়ম্বরে বিনা জনতায় হয়শান্তিনিকেতনের শালবনের মধ্যে আমার স্মরণের সভা মর্মরিত হবে, মঞ্জরিত হবে, যেখানে যেখানে আমার ভালোবাসা আছে, সেই সেইখানেই আমার নাম থাকবে।’ আর ছাতিমের সাথে শান্তিনিকেতনের জন্মকথা জড়িয়ে থাকা, এখনো ছাতিমতলায় উৎসব বা সমাবর্তনে ছাতিমের পাতা উপহার দেয়া রবীন্দ্রনাথ আর ছাতিমকে অঙ্গাঅঙ্গি করে রেখেছে।

জামালখান রোডের ছাতিমতলায় হাতে ছাতিম, চারপাশ তার সৌরভে সুরভিত মনে রবীন্দ্রনাথ ভাবনা থেকে গুনগুন করে ভর করল সাহানা বাজপেয়ীর গানের কলি ‘তোমার দিকে হেঁটে যাওয়ার/ রাস্তাজোড়া ছাতিমফুল/ আরামরোদের বিকেল এলায়/ ঠিক যেন কার মনের ভুল/ ছাতিমফুলের গন্ধে মাতাল/ যে রাস্তাটা, তার বাঁকে/ তারার টীপে সন্ধ্যেআকাশ/ খুব নীরবে হাত রাখে।’

সারাদিনের ব্যস্তনগরীতে ব্যস্ততম সন্ধ্যাটা ছাতিমের সুগন্ধ স্নানে স্নিগ্ধতর হয়ে উঠলো। একটা রিকশা করে চট্টগ্রামের অস্থায়ী ঠিকানায় ফেরার পথে বহুদূর ছাতিমের সাথেই ছিল সেই সন্ধ্যায়। তবে কুড়িয়ে আনা ছাতিমে কিন্তু অতটা সুগন্ধ ছিল না। দূর থেকেই ছাতিমের সুগন্ধে বেশি মাতায়োরা হয়। আর শেষরাতেই ছাতিম সবচেয়ে বেশি সুতীব্র হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামে থেকে ফিরেছি। শীত আসেনি তাই ছাতিম এখনো সুরভিত করে চলেছে ঢাকার অনেক সড়ক। হঠাৎ পাওয়া চট্টলার সেদিনের ছাতিম সন্ধ্যাটা স্মৃতির কোটরে পাকাপাকি স্থান নিয়েছে। খুব মন খারাপের সময় বা মন ভালোর সময় স্মৃতির কোটর থেকে এই সন্ধ্যাটাকে বের করে এনে আবারো স্নিগ্ধ হয়ে ওঠা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছুরিকাহত ব্যক্তিকে রাস্তায় ফেলে গেল দুর্বৃত্তরা
পরবর্তী নিবন্ধসিআইইউতে এআই নির্ভর সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট বিষয়ক সেমিনার