সমপ্রতি ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকের বাসিন্দা হলেন কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুুল্লাহ্ আল নোমান। যিনি এ চট্টগ্রামের একজন কৃতী পুরুষ। শুধু তাই নয়, তিনি একজন খ্যাতিমান রাজনীতিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং চট্টলপ্রেমিক। পরিচ্ছন্ন, সজ্জন ও কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব। মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একজন সাদা মনের মানুষও বটে। যাঁর ছিল চট্টগ্রামের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। চট্টগ্রাম উন্নয়নে যাঁদের অনন্য অবদান ও ভূমিকা রয়েছে, তন্মধ্যে আব্দুল্লাহ্ আল নোমান অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচ্য। চট্টগ্রামের উন্নয়নে তাঁর অহর্নিশ প্রয়াস, প্রচেষ্টা, অবদান কখনো বিস্মৃত হবার নয়। তাঁর ভাবনাজুড়ে থাকতো চট্টগ্রাম এর বিষয়টি। তিনি কেবল সরকারের অংশীজন হিসেবে নয়, সরকারের বাইরে থেকেও সর্বদা চট্টগ্রামের উন্নয়ন আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন। ৮০ এর দশকে গঠিত বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক পালিত চট্টগ্রামের উন্নয়ন সংক্রান্ত বিবিধ কর্মসূচিতে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা চট্টলবন্ধু এস এম জামাল উদ্দীনের সাথে সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে এ সংস্থার আন্দোলন–সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। অতঃপর ১৯৯১ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবিগুচ্ছ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠা, চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের আধুনিকায়নে ফ্লাড লাইট সংযোজন, চট্টগ্রামে স্বতন্ত্র টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিষ্ঠায় ভবন নির্মাণ, বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম এর ১০০ ট্রান্সমিটারে উন্নীতকরণ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আধুনিকায়নসহ ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ, কর্ণফুলী ৩য় সেতু নির্মাণ, চট্টগ্রামে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছাড়াও চট্টগ্রামের উন্নয়নে বহুমাত্রিক অবদান রাখেন তিনি। এছাড়াও ১৯৯৪ সনে তৎকালীন সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মাধ্যমে ঐতিহাসিক লালদিঘি ময়দানে নির্বাচনী জনসভায় চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণার বিষয়টিতেও ছিল তাঁর নেপথ্য ভূমিকা। যদিও সরকার পরিবর্তন হওয়ার কারণে তা জাতীয় সংসদে বিল আকারে এনে বাণিজ্যিক রাজধানীর আইনগত ভিত্তি দেয়া হয়নি। তথাপি এটি এখনো চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণের দাবি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আশা করবো বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। উল্লেখ্য যে, প্রয়াত আবদুল্লাহ আল নোমানকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির যাবতীয় আন্দোলন–সংগ্রামের সফলতার নেপথ্য মাস্টারমাইন্ড বললেও অত্যুক্তি হবে না।
তৎকালীন সময়ে মন্ত্রীসভায় চট্টগ্রামের দায়িত্বে থাকা আবদুল্লাহ্ আল নোমান সাহেবের চট্টগ্রাম উন্নয়নে আন্তরিক সহযোগিতা ছিল অকল্পনীয়। যেমন চট্টগ্রামে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির স্থায়ী পরিষদের সভাপতি, ডেইরি ফার্ম এসোসিয়েশনের সভাপতি, দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা চট্টলদরদী মরহুম মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী যখন আন্দোলনের সুচনা করেন তখন জনাব আব্দুল্লাহ্ আল নোমান পশু সম্পদ মন্ত্রাণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। আর এই আন্দোলন সফলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছার অন্তরালে ছিল নোমান সাহেবের ভূমিকা। এভাবে বাস্তবায়ন করা উপরেল্লিখিত উন্নয়ন দাবীগুলো বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটিরই ছিল। এসব দাবী সরকারের দৃষ্টিতে নিয়ে যেতে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি সরকার প্রধানের প্রতি স্মারকলিপি প্রদান, একাধীক বার সংবাদ সম্মেলন করে ৬ ঘণ্টা থেকে শুরু করে ১২, ২৪ ও ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত হরতাল, অবরোধ, অনশন ও অবস্থান কর্মসুচিসহ নানা আঙ্গিকে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। আর দাবীগুলো বাস্তবায়নে সরকারের ভিতর থেকে সহোযোগিতা করেছেন জনাব আব্দুল্লাহ্ আল নোমান ভাই।
যাই হোক, চট্টগ্রামের প্রতি তাঁর দরদ ও মমত্ববোধ ছিল প্রশ্নাতীত। উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সনে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি চট্টগ্রাম মহানগর এর শহিদ মিনার চত্বরের একটি সম্মেলনে তাঁকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করার জন্য তাঁর কাতালগঞ্জস্থ বাসায় যাই আমি এবং নগর কমিটির সভাপতি প্রয়াত হাকিম আলহাজ্ব মুহাম্মদ উল্লাহ্। তখন নোমান ভাইয়ের বাসায় নেতা কর্মীদের উপচে পড়া ভিড়। এতদসত্ত্বেও যথারীতি সালাম বিনিময় করে আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। অত্যন্ত ভদ্রোচিত ও মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। যেখানে ছিল না কোনো প্রকার অহংকারী মনোবৃত্তি ও দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গী। বরঞ্চ দৃশ্যমান হলো হৃদ্যতাপূর্ণ অকৃত্রিম ভালোবাসা। যথারীতি আমরা পরিচয় দিয়ে আমাদের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলাম। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অর্থাৎ মাত্র একদিন পরেই আমাদের অনুষ্ঠান। তথাপি কোনো রাখঢাক না রেখে এবং কোনরূপ ব্যস্ততার অজুহাত না দেখিয়ে তিনি বিনাবাক্য ব্যয়ে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। উপরন্তু এমনটি বলে আমাদের বিস্মিত করলেন যে, এটি তো আমাদের সংগঠন, অবশ্যই আমি আসবো। অতঃপর আমাদেরকে আপ্যায়ন করে বিদায় দিলেন। আমরাও অতীব তুষ্টচিত্তে চলে আসলাম। পরদিন যথারীতি তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন। ২০০৭ সনে আমি আরব আমিরাত সফরে গেলে সেখানে শারজাহ্ রোলাতে আমার সাথে বি এন পি নেতা জনাব আবু সুফিয়ান ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। তখন তিনি কুশল বিনিময়ের ফাঁকে সেখানে নোমান ভাই আছেন বলে জানালে আমি সুফিয়ান ভাইয়ের মারফত নোমান ভাইয়ের নিকট সালাম দিতে বলি। পরের দিন সুফিয়ান ভাই আমাকে জানান নোমান ভাই আমাকে একদিন তার সাথে ডিনার করতে বলেছেন। অতঃপর আমি তাঁর দাওয়াতে অংশগ্রহণ করি। নোমান ভাই এর আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করে। তাঁর দাওয়াতে গিয়ে বুঝলাম, নোমান ভাই সত্যিকারের একজন চট্টলপ্রেমী মানুষ। তিনি আমার মত একজন নগণ্যকে দীর্ঘক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখেন। তারপর সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি তার আন্তরিক আতিথেয়তা, চট্টগ্রামের উন্নয়নে ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, সরকারের নানা পর্যায়ে চিঠি আদান–প্রদানের কপি প্রদর্শন, আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের বিভিন্ন ডকুমেন্টস্, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরাবরে দেয়া চিঠি, মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের ফটোকপি, ডিও লেটারসহ আনুষঙ্গিক নানা কাগজপত্র দেখান। তারপর বিদায় বেলায় এই দেশদরদীর চোখের কোণায় জমে উঠা পানি দেখে নিজেকে সামলাতে পারিনি। দেশ মাতৃকার টান, দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসা সর্বোপরি চট্টগ্রামের জন্য তার দরদ সত্যিই আমাকে আপ্লুত করে। তারপর ২০০৯ সনের জানুয়ারী ৩১ তারিখে আমার বাবার ইন্তেকাল এর খবর পেয়ে নামাজে জানাজায় ছুটে আসেন আবদুল্লাহ আল নোমান ভাই। নোমান ভাইয়ের উপস্থিতি আমার প্রতি তার আন্তরিক ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করি, যৎকারণে আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। সর্বশেষ ২০২৩ সনে তাঁর সাথে নগরীর ভি আই পি টাওয়ারসহ তার বাসায় আমার শেষ দেখা। তখন তিনি প্রায় অসুস্থ ছিলেন। আমিও তখন ভিআইপি টাওয়ার একই আঙিনায় থাকতাম কারণে প্রায়ই দেখা হতো। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, যা ভাবতেও অবাক লাগে। তিনি তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে আজীবন বেঁচে থাকবেন চট্টগ্রামবাসীর অন্তরে। তিনি একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। তাঁর পদাংক অনুসৃত হলেই জাতীয় জীবনে একটি সুস্থ, সুন্দর, স্থিতিশীল ও মানবিক মূল্যবোধের সমাজ বিনির্মাণ অধিকতর সম্ভব। চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ্ জাতীয় মসজিদ ময়দানে তার বিশাল নামাজে জনাজায় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে নোমান ভাই কতো জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন। শেষ যাত্রায় আব্দুল্লাহ্ আল নোমান ভাইয়ের একমাত্র সন্তান সাইদ আল নোমান তুর্যের বক্তব্যে মানুষ নোমান ভাইকে খুঁজে পেয়েছে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের উঁচু মকাম দান করুন।
লেখক : মহাসচিব, বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি। এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (ইভিপি), এসোসিয়েশন অব ট্রাভেলস্ এজেন্টস্ অব বাংলাদেশ (আটাব)।