
প্রথিতযশা গবেষক, চট্টলতত্ত্ব বিশারদ, ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরী “চন্দ্রাবতী” কাব্যের রচয়িতা কবি কোরেশী মাগন এর সপ্তম অধস্তান পুরুষ। তিনি ২৪ শে আগস্ট ১৯২২ সালে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানাধীন নোয়াজিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এবং ১৯৯৪ সালের ২৬শে অক্টোবর ৭২ বৎসর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতা আলহাজ্ব সরফুদ্দীন ইঞ্জিনিয়ার একজন দানশীল ব্যক্তি হিসাবে খ্যাত ছিলেন। তিনি রেঙ্গুন পোর্ট কমিশনের ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং ১৯৩৫ ইংরেজিতে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩০ ইংরেজিতে স্বগ্রামে “নোয়াজিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা করেন। মাতা মোমেনা খাতুন চৌধুরী, রাউজান থানার ডাবুয়া গ্রামের প্রাচীন জমিদার দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরীর তৃতীয় অধস্তন পুরুষ আলহাজ্ব ইসমাইল চৌধুরীর একমাত্র কন্যা। ১৯৭১ সালে মহান জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার দায়ে আবদুল হক চৌধুরী ১৯৭১ সালের আগষ্ট মাসের এগার তারিখ পাক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার ও নির্যাতিত হন। এবং পরবর্তীতে জামিনে মুক্তিলাভ করেন।
লেখালেখি : ১৯৪৩ থেকে ঐতিহাসিক উপাদান, বই–পান্ডুলিপি সংগ্রহ। খ্যাতনামা ঐতিহাসিক, পন্ডিতদের সঙ্গে লেখালেখি, মত বিনিময় এবং অত্যন্ত ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে লেখাপড়া। গভীর দেশপ্রেম ও সাধনা, ঐকান্তিক আগ্রহ এবং পরিশ্রম সহকারে চট্টগ্রামের ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, সংস্কৃতি, সাহিত্য তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির উপর একনিষ্ঠ গবেষণা বিভিন্ন ঐতিহাসিক জায়গায় গমন এলাকাগুলির ইতিহাস এর উপর দীর্ঘ কালের পঠন, অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ ও গবেষণায় লিখিত বিভিন্ন প্রবন্ধ, চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন পত্র–পত্রিকা, সাময়িকীতে ১৯৭২ থেকে প্রকাশিত হয়ে সুধীমহলের প্রশংসা অর্জন করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থাবলী : ১। চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ। ১ম সংস্করণ (প্রথমও দ্বিতীয় খন্ড একত্রে) ফেব্রুয়ারী ১৯৭৬। ২। চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ– ২য় সংস্করণ ১৯৮০ ইংরেজি। ৩। চট্টগ্রামের চরিতাভিধান–ডিসেম্বর ১৯৭৯ ইংরেজি। ৪। চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি – ডিসেম্বর ১৯৮০ ইংরেজি। ৫। সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ– ১ম সংস্করণ ১৯৮১, ২য় সংস্করণ ১৯৯০ ইং। ৬। শহর চট্টগ্রামের ইতিকথা– এপ্রিল ১৯৮৫ ইংরেজী। ৭। চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা– বাংলা একাডেমী, যে ১৯৮৮ ইংরেজি। ৮। চট্টগ্রাম আরাকান– জুন ১৯৮৯ ইংরেজি। ৯। চট্টগ্রামের ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধ–নভেম্বর ১৯৯২ ইংরেজি। ১০। প্রাচীন আরাকান, রোহিঙ্গা, হিন্দু ও বড়ুয়া, বৌদ্ধ অধিবাসী–বাংলা একাডেমী, জানুয়ারী ১৯৯৪ ইং। ১১। বন্দর শহর চট্টগ্রাম–বাংলা একাডেমী, ঢাকা, বাংলাদেশ, মে ১৯৯৪ ইংরেজী। ১২। প্রবন্ধবিচিত্রা : ইতিহাস ও সাহিত্য– বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৯৫ ইংরেজী। (সংকলিত চট্টলত্ত্ববিদ, গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর জীবন বৃত্তান্ত থেকে)
আবদুল হক চৌধুরী, ইতিহাসবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, গবেষক, তিনি রাজা মহারাজাদের ঐতিহাসিক নন, তিনি গণমানুষের ইতিহাসবিদ, সমাজের নিম্নতলার মানুষের ইতিহাস তাঁর বইতে রয়েছে।
অত্যন্ত লোকজ বিষয়গুলো অত্যন্ত সাবলীলভাবে তাঁর বইতে স্থান করে নিয়েছে, এখানে কোন তাত্ত্বিক বিষয় নয়। এ ছিল তাঁর একান্ত নির্ভেজাল নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং সমীক্ষণ যা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন সেটাকে তিনি তুলে এনেছেন। ইতিহাসের পাতায়, এ বিষয়গুলো হয়ত অন্যকোন ঐতিহাসিকের লেখায় না থাকার সম্ভাবনাই বেশী, সমাজের মধ্যবিত্ত ও বিত্তবানদের কাহিনী বা উপাখ্যান লেখার লোকের অভাব হয়না। কিন্তু যারা বাতির অন্ধকারের নীচে থাকে তাদেরকে ইতিহাসেই অঙ্গীভূত করা ছিল তার গবেষণার মূল বিষয় এবং লক্ষ্য। তিনি খুবই কম গাড়ি ঘোড়ায় চড়তেন, পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল তিনি এ চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন তথ্য সন্ধানের মানসে। লোকের মুখে শোনা কাহিনী এ তথ্য তিনি তাঁর লেখায় নিয়ে আসতেন। তাঁর এ বর্ণনাগুলো ছিল নির্ভেজাল এবং তথ্য সমৃদ্ধ আর জীবন্ত। তাঁর ইতিহাসকে বলা যায় লোকজ এক নির্ভেজাল তথ্য সমৃদ্ধ এক সমৃদ্ধ ইতিহাসের সম্পদ। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন ও চিন্তার ফসল তাঁর সৃষ্টিগুলো। এখানে অনেক বিরল বিষয়কে তিনি তাঁর লেখার স্থান দিয়েছেন যেগুলো অন্যকোন ইতিহাস গ্রন্থে বিশেষত: চট্টগ্রামের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া বিরল।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন পরিবার নিয়ে তাঁর যে তথ্য বিবরণী তা সত্যিই নিখুঁত। লোক সাহিত্যের এক অতুলনীয় সম্পদ যেমন সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে এবং সাহিত্যকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে যায় তেমনি আবদুল হক চৌধুরীর কাজগুলো লোক কাহিনী বিষয়বস্তুকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তিনি লোক সমক্ষে উপস্থাপন করে তার স্থান যা তাকে তা তিনি দিয়েছেন। এ দুষ্প্রাপ্য এবং অমূল্য তথ্যগুলো তিনি একাগ্রমনে গবেষণার আঙ্গিকে আহরণ করে তাঁর ইতিহাস মূল্যকে তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাই তাঁর ইতিহাসের বিষয়গুলো ভিন্ন মাত্রিক এবং একক, এসব লোকজ উপাদান দিয়ে গড়া। তাঁর ইতিহাস অনেক সময় লোকজ বা আঞ্চলিক নাম তিনি অনাবিলভাবে ব্যবহার করে তাঁর Authenticity– কে বাড়িয়ে দিয়েছেন। এখানে তিনি কোন কারসাজির আশ্রয় নেননি। এক বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহাসিক আবদুল হক চৌধুরী নিরাম্ভর জীবন যাপন করতেন। তার গভীর স্নেহের পরশ আমি পেয়েছি খুব কাছ থেকে। ফরাসী সাহিত্যের ইতিহাসের লেখাগুলো তিনি নিয়মিত পড়তেন আজাদী পত্রিকায় এবং তাঁর প্রশংসা করে তিনি আমাকের বলতেন তিনি এর পুরোটা পড়তে চান এবং সে জন্যে আমি যেন তাড়াতাড়ি লিখে এটা তাঁকে পড়ার সুযোগ দিই। কি পরিমাণ ইতিহাস প্রেমিক এবং ইতিহাস সচেতন হলে একজন লোকের মুখ থেকে একথা শোনা যায়। স্বল্পভাষী এবং সাদাসিধা জীবনযাপনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এ জ্ঞানপুরুষ সব সময় সমাজকে আলোকিত করে গেছেন এবং আমাদের সবার জন্য সে আলোকরশ্মি জ্বালিয়ে রেখে গেছেন। সব সময় নির্মোহ বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার লোক আজ বিরল। সে স্থানটা উনি দখল করে আছেন এবং সে স্থানে তিনি আমাদের সবার দিশারী হয়ে চিরকাল থাকবেন। জ্ঞান পিপাসু এ প্রাজ্ঞজন কোন প্রাতিষ্ঠানিক সনদ বা ডিগ্রী না নিয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদ না নিয়ে তিনি ইতিহাসবিদ; এ যেন এক চারণ কবি বা লোককবি যারা নিজেরাই তাদের সৃষ্টির সৃষ্টা, তিনিও একইভাবে তার নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি ইতিহাস রচনা করে গেছেন। যেগুলো নির্ভেজাল এবং নিস্কলুষ রচনা।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে তিনি কেন এ ইতিহাস রচনায় হাত দিলেন, এখানে দুটো বিষয় হতে পারে, তিনি একজন ইতিহাস সচেতন ব্যক্তি এবং দ্বিতীয়টা হলো তিনি সমাজের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা অনুভব করেছেন এবং দেখেছেন অর্থ নিয়ে কিভাবে ইতিহাস বিকৃত করে এক অসত্যের ভান্ডার অবলম্বন করে জাতি ও সমাজকে কলংকিত করছেন কিছু তথাকথিত ঐতিহাসিক। তিনি অনেকটা হাত দিয়ে ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন ইতিহাস কিভাবে লিখতে হয়। এটি একটা নির্মোহ বর্ণনা। যেখানে কেবল সত্যিটাই মূল বিষয় এবং সে সত্যের প্রতিষ্ঠার্থে ঐতিহাসিককে বস্তুনিষ্ঠ এক সাধক ও গবেষক হতে হয়। আর আবদুল হক চৌধুরী ছিলেন সে সত্য সন্ধানী এক সন্ন্যাসী।
তাঁর লেখায় ভাষায় এক গতিময়তা আমরা লক্ষ্য করি। পড়তে পড়তে আমরা আকৃষ্ট হয়ে যাই। আড়ষ্ট হই না। অনেক সময় তিনি তাঁর গবেষণায় বিভিন্ন তথ্যপঞ্জি এবং গ্রন্থপঞ্জি নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করে তাঁর জ্ঞানের এবং অনুসন্ধানের যে ব্যাপ্তি তাকে আমাদের সামনে প্রতিভাত করেছেন। তিনি বিভিন্নভাবে সম্মানিত এবং সমাদৃত হয়েছেন তাঁর কাজের মূল্যায়নের মাধ্যমে। এ বিষয়গুলো তাঁর উপর প্রণীত চট্টলতত্ত্ববিদ গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর জীবনবৃত্তান্তে আমরা খুঁজে পাই। তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন সব সময়, যেটা তাঁর সমাজদরদী চেতনার ও অসামান্য দৃষ্টান্ত, ছোট হোক বা বড়ো হোক তিনি কোন বাছাই করে কোন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হননি, এখানে রয়েছে এক সহজ সরল মানসিকতার এক ইতিহাসবিদ–এর পরিচয় যিনি চিন্তা ও চেতনায় ছিলেন একজন গণ–মানুষের ইতিহাসবিদ, এ স্বীকৃতি আমার দৃষ্টিতে তারজন্য হবে এক সঠিক মূল্যায়ন। আপোসহীন এক সত্য সন্ধানী ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরী তাঁর অসামান্য সৃষ্টির জন্য সবার জন্যে অনুপ্রেরণা ও আদর্শ। এই ইতিহাসপাগল জ্ঞান তাপস আবদুল হক চৌধুরী–কে জানাই আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা।
লেখক : সম্পাদক, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, চট্টগ্রাম।











