জরাজীর্ণ রেল লাইন, মেয়াদোত্তীর্ণ সেতু ও পুরনো ইঞ্জিন-কোচের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে ভ্রমণ। বিশেষ করে আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত বারবার দুর্ঘটনার কারণে সিলেট-আখাউড়া রেলপথ যাত্রীদের জন্য আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। নতুন বছরের শুরুতেই গতকাল মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে এই রুটে। গত বছরের ১৬ আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আরো ৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এজন্য ৬টি তদন্ত কমিটিও হয়েছে। কিন্তু কোন শাস্তি হয়েছে তা শোনা যায়নি। ২০১৯ সালে এই রুটে অন্তত ২১ টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে ২৩ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায়। সেদিন ঢাকাগামী উপবন এঙপ্রেসের পাঁচটি বগি সেতু ভেঙে ছড়ায় পড়ে যায়। এতে পাঁচ জন নিহত ও শতাধিক যাত্রী আহত হন। জানা গেছে, প্রতিটি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় তদন্ত হয়, কিন্তু প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পায়না। নানান ধরনের প্রভাবে তারা পার পেয়ে যায়।
এই রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৭৯ কিলোমিটার। জরাজীর্ণ হয়ে পড়া এই সেকশনে রয়েছে ১৩টি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু। রেলওয়ের ভাষায় যা ‘ডেডস্টপ’। লাইনও ত্রুটিপূর্ণ। এসবের সঙ্গে রয়েছে পুরনো ইঞ্জিন আর বগি। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনি এঙপ্রেসে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ হাজার যাত্রী সিলেট-ঢাকা এবং সিলেট-চট্টগ্রাম যাতায়াত করেন।
তবে এই ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুক্তগীন আজাদীকে জানান, চট্টগ্রাম-সিলেট রেললাইনের অবস্থা ভালো। গত বছর এই রুটে আমরা অনেক কাজ করেছি। স্লিপারের কাজ করেছি, রেললাইনের কাজ করেছি। এরমধ্যে দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে বেশি গতিতে চলার কারনে। আর আজকে (গতকালের) যে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটি হলো-আমাদের লোকজন লাইনের কাজ করছিল সিগন্যাল না দিয়ে। রেলওয়ে প্রকৌশল এবং পরিবহন বিভাগ থেকে জানা গেছে, গত বছর সর্বশেষ দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ৬ ডিসেম্বর। সেদিন দুপুরে মাধবপুরের শাহাজীবাজার রেলস্টেশনের পাশে তেলবাহী ট্রেনের পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এ কারণে ১৩ ঘণ্টা সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকে। এর আগে ১১ নভেম্বর সিলেট ও মৌলভীবাজারের মধ্যবর্তী ভাটেরায় মালবাহী ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে বন্ধ হয়ে যায় সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ। এর আগে ৭ নভেম্বর সাতটি বগি নিয়ে শ্রীমঙ্গলে তেলবাহী একটি ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়। এতে ২৩ ঘণ্টা বন্ধ থাকে রেল যোগাযোগ। এর আগে ৩০ অক্টোবর সিলেট রেলস্টেশনে ডকইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়িকা এঙপ্রেসের সামনের দিকে ধাক্কা দেয় জয়ন্তিকা এঙপ্রেস। ১৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও এলাকায় তেলবাহী ওয়াগনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ২৩ আগস্ট যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয় কুলাউড়া এলাকায়। একই স্টেশনে গত বছরের ২৪ জানুয়ারি ট্রেনের বগিতে আগুন ধরে যায়। এভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। শুধুমাত্র গত বছরের নভেম্বরে এই রুটে তিনবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে ট্রেন।
সিলেট রেলের একজন প্রকৌশলী জানান, এই রুটের মতো এত দুর্ঘটনা তিনি তার চাকরি জীবনে কখনও দেখেননি। রেলওয়ের প্রকৌশল শাখা জানায়, সিলেট-আখাউড়া সেকশনের অতিঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলোর মধ্যে রয়েছে- শমসেরনগর-টিলাগাঁও সেকশনের ২০০ নম্বর সেতু, মোগলাবাজার-মাইজগাঁও সেকশনের ৪৩, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর সেতু, কুলাউড়া-বরমচাল সেকশনের ৫ ও ৭ নম্বর সেতু, সাতগাঁও-শ্রীমঙ্গল সেকশনের ১৪১ নম্বর সেতু, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ১৫৭ নম্বর সেতু, মাইজগাঁও-ভাটেরাবাজার সেকশনের ২৯নং সেতু এবং মনতলা-ইটাখোলা সেকশনের ৫৬ নম্বর সেতু। এ সেতুগুলো সংস্কারের কোনো প্রকল্প না থাকায় এখনই এগুলো সংস্কারের সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ডুয়েল গেজ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি: চট্টগ্রাম থেকে আখাউড়া এবং ঢাকা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রেল লাইনের অবস্থা মোটামুটি ভালো। রয়েছে ডুয়েল গেজ লাইন। কিন্তু আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ব্রিটিশ আমলের রেল লাইনেই চলছে ট্রেন। গত বছরের এপ্রিলে সিলেট-আখাউড়া রেলপথকে ডুয়েল গেজে রূপান্তরিত করার জন্য একনেকে ১৬ হাজার ১৪৪ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ১৭৯ কিলোমিটার আখাউড়া-সিলেট রেলপথের পুরোটাই জরাজীর্ণ। এই সেকশনে ৯০ শতাংশ সেতু মেয়াদোত্তীর্ণ। তার মধ্যে ১৩টি মহা-ঝুঁকিপূর্ণ সেতু (ডেডস্টপ)। সেই সঙ্গে এই রুটের সব ট্রেনের বগি-ইঞ্জিন অনেক পুরনো। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের তথ্য মতে, নির্মাণের ৫০-৫৫ বছর পরই সেতুর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। অথচ এ রুটের ৯০ শতাংশ সেতুর বয়সই ৭০ বছর পেরিয়েছে। রেলওয়ে র্কর্তৃপক্ষ এ রকম ১৩টি স্পটকে ‘ডেডস্টপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে আটটি এবং মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে পাঁচটি সেতু ডেডস্টপ।