মাননীয় মেয়র, আপনি বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচন করেছিলেন। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এর সংসদ নির্বাচনের মত আপনাকে পেশী শক্তি ও প্রশাসনিক শক্তি জোর করে হারিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আইনী লড়াইয়ে জিতে আদালতের সিদ্ধান্তে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, বিগত চসিক নির্বাচনে জালিয়াতি ও কারচুপি হয়েছিল এবং আপনাকে জোর করে হারানো হয়েছিল। নির্বাচনে আপনাকে মেকানিজম করে হারানোর বিষয় প্রমাণিত হওয়ায় আপনাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। আদালতের এই সিদ্ধান্ত আসতে এত দেরী হল যে, ইতিমধ্যে প্রায় ৪ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। আদালতের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আপনি মেয়রের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে আপনি শুধু বছর খানেক সময় পাবেন। মেয়র পদটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। জনপ্রিয়তা অর্জন এবং দ্রুত জনপ্রিয়তা হারানোর জন্যেও এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ও বিপজ্জনক পদ। এই পদটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপজ্জনক তাদের জন্যই, যারা সৎ এবং যাদের জনপ্রিয়তা ও সম্মান হারানোর ভয় থাকে। আর যারা এই পদটিকে টাকা কামানোর এবং আখের গোছানোর মাধ্যম বলে মনে করেন তাদের জন্য মেয়রের পদটি আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতই।
মাননীয় মেয়র, নগরবাসী বিশ্বাস করে আপনি সৎ মানুষ। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াকে আপনি ভয় পান, আপনি দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার মত আপনার সৎ সাহস আছে। কিন্তু মাত্র এক বছর সময়ের মধ্যে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সিটি কর্পোরেশনকে আপনি কিভাবে উদ্ধার করবেন। নগরবাসী সিটি কর্পোরেশনের উপর চরমভাবে বিরক্ত। মশার উপদ্রব, জলাবদ্ধতার কারণে বর্ষার সময় নগরীর বেশ কয়েকটি স্থানে মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ, রাস্তার খান–খন্দ, হকার সমস্যা, রাস্তার উপর কাঁচা বাজার বসানো ইত্যাদি আরও অনেক কারণ এবং প্রকৌশল ও রাজস্ব বিভাগের ঘুষ দুর্নীতি নগরবাসীকে চসিকের প্রতি ক্ষুদ্ধ করে তুলেছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য বিগত ২০ বছরে মেয়র সাহেবেরা অনেক হাজার কোটি টাকা খরচ করেছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করার পরও কেন জলাবদ্ধতা সমস্যার সামান্যতম উন্নতিও হল না, এর জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বা দুর্নীতি দমন কমিশন বা সরকারের অন্য কোন বিভাগ থেকে কেন কোন কৈফিয়ত তলব করা হল না? হাজার হাজার কোটি টাকা নয় ছয় করলে যেখানে হিসাব দিতে হয় না বা জবাবদিহি করতে হয় না, সেখানে তো দুর্নীতি হবেই।
মাননীয় মেয়র, চসিকের সকল সমস্যার বিষয়ে আপনার সম্যক ধারণা অর্জন করা প্রয়োজন। এর মধ্য হতে আপনার মেয়াদকালীন সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা যায় এমন কাজসমূহ সম্পন্ন বা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যেসব কাজ আপনার মেয়াদের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, যেমন জলাবদ্ধতা, সে সব বিষয়ে এবং বিগত মেয়রদের দুর্নীতির বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে নগরবাসীদের চসিকের সকল অনিয়ম এবং সমস্যার বিষয়ে অবহিত করা প্রয়োজন। অতীতের মেয়রদের অপকর্মের দায় আপনি নেবেন কিনা এবং আগামী এক বছর তিন মাস মেয়াদের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান করার মত যাদুর কাঠি আপনার হাতে আছে কিনা সে বিষয়ে নগরবাসী–কে জানানো আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
মাননীয় মেয়র, আপনার স্বল্পকালীন মেয়াদের মধ্যে বাস্তবায়ন করা যায় এমন দু’একটি বিষয়ের প্রতি মনযোগ আকর্ষণ করছি। (ক) মশার উপদ্রবে নগরবাসী অতিষ্ট। নগরীর অভ্যন্তর ভাগের মূল অংশে যেসব স্থানে ডোবা নেই শুধু নালা আছে, সেসব নালায়, যে তাপমাত্রায় মশার লার্ভা, জীবানু, কীট পতঙ্গ মরে, সেই উচ্চ তাপমাত্রায় ঔষধ মিশ্রিত গরম পানি প্রবাহিত করালে এডিস মশার লার্ভা সহ অন্যান্য সকল প্রকার জীবানু এবং কীটপতঙ্গ ধ্বংস হয়ে যাবে। এর পাশাপাশি নগরীর যে সকল স্থানে ডোবা রয়েছে, সে সব ডোবায় উচ্চমানের লার্ভা এবং সকল প্রকার ক্ষতিকর জীবাণু বিধ্বংসী ঔষধ ছিটানো যেতে পারে। নালায় গরম পানি প্রবাহের জন্য যে সব গাড়ী ব্যবহার করা হবে সেইসব গাড়ীতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি গরম হওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। বর্তমানে ব্যবহৃত মশার ঔষধের মান এবং কার্যকারিতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কারণ গুজব আছে যে, এই ঔষধে ভেজাল আছে। (খ) চসিকের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে সব ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত খালি জায়গা নেই। যে সব ওয়ার্ডে চসিকের মালিকানাধীন খালি জায়গা আছে এবং যে সব ওয়ার্ডে চসিকের মালিকানাধীন খালি জায়গা নেই, অথচ ব্যক্তিগত মালিকানাধীন খালি জায়গা আছে, এসব জায়গায় সুপরিকল্পিভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করে, আগামী দিনের কথা মাথায় রেখে এসব খালি জমিতে বড় বড় দিঘি বা পুকুর খনন করা যেতে পারে। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির জন্য জমির মালিককে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যদি এটা করা যায় তাহলে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে এসব দিঘির বা পুকুরের পানি কাজে লাগবে, আবহাওয়া ঠাণ্ডা থাকবে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ঠিক থাকবে, মাছ চাষ হবে, পাড়ে গাছ লাগানোর ফলে পরিবেশ উন্নত থাকবে, বসার স্থান করে দিলে মানুষ অবসর সময়ে সেখানে সময় কাটাতে পারবে; নগরীতে যতটি সম্ভব দৃষ্টি নন্দন পুকুর বা দিঘি খনন করা হলে চট্টগ্রাম নগরীর পরিবেশ প্রতিবেশের আমূল পরিবর্তন ঘটবে এবং বায়ু দূষণ স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসবে। (গ) পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে চট্টগ্রামনগরীকে প্লাস্টিক এবং পলিথিন মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। চসিক কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে পারে এবং বুয়েটের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করতে পারে। প্লাস্টিকের রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট স্থাপন করে পুনঃ ব্যবহারযোগ্য পন্য উৎপাদনের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ থেকে মুক্তিসহ অনেক সুফল পাওয়া যাবে। পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের দাবী। পাট মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে পলিথিনের বিকল্প দৃষ্টি নন্দন পাটজাত পণ্য উৎপাদন করার মাধ্যমে পলিথিনের বিকল্প চালু করা যেতে পারে। পলিথিন এমন একটি পদার্থ যা পচে না, যা মাটির উর্বরতা নষ্ট করে, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। এটি মানবজীবনের নিরাপত্তার জন্য হানিকারক। তাই প্লাস্টিক রিসাইক্লিং প্লান্ট স্থাপন এবং পলিথিন ব্যবহার বন্ধের জন্য অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। (ঘ) মাননীয় মেয়র, চসিকের প্রকৌশল এবং রাজস্ব বিভাগকে একটা ভালভাবে ঝাঁকুনি দেওয়া প্রয়োজন। এ দুটি বিভাগ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। চসিকের এই দুই বিভাগের সকল কর্মকর্তা পর্যায়ের লোকের বিষয়ে তদন্তের জন্য তাদের তথ্যাবলী সম্বলিত ফাইল দুদকে পাঠানো দরকার। (ঙ) মাননীয় মেয়র বিগত সরকারের আমলে আপনার পূর্বসূরী মেয়রগণ ঐতিহাসিক বিপ্লব উদ্যানকে বাণিজ্যিক উদ্যানে পরিণত করে গিয়েছেন। মানুষের চাওয়া বিপ্লব উদ্যানটিকে আপনি দৃষ্টি নন্দনভাবে গড়ে তুলুন। এখানে যেন শুধু সীমানা প্রাচীর এবং পাবলিক টয়লেট ছাড়া অন্য কোন ইট, সিমেন্ট, লোহার তৈরী কোন স্থাপনা না থাকে। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দৃষ্টিনন্দন করে উদ্যানটি গড়ে তুলুন যাতে দিনে সূর্যের আর রাতে চাঁদের আলো এই উদ্যানে সহজে প্রবেশ করতে পারে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে দৃষ্টি নন্দন গাছ, ফুলের বাগান এবং ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য বসার স্থান নির্মাণ করতে হবে। এখানকার রোপন করা গাছের শাখায় নানা জাতের পাখীদের কলরব এবং এখানকার অক্সিজেন সমৃদ্ধ বিশুদ্ধ বাতাস ভ্রমণকারীদের মন আমোদিত ও প্রফুল্ল করবে। যারা এখনও সেখানে দোকান নিয়ে বসে আছেন তাদের সরাতে হবে।
লেখক : বর্ষীয়ান নাগরিক ও সমাজকর্র্মী