চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ও বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী

ড. মনজুর-উল-আমিন চৌধুরী | সোমবার , ১০ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ১৯৩০ ভারতীয় উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমাদের বিবেচনায় চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সশস্ত্র প্রকাশকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূলস্রোতের একটি বিশেষ প্রবাহ। এ.আর. দেশাই ‘Social Background of Indian Nationalism’ ও রজনী পাম দত্ত ‘India Today’ গ্রন্থে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমাজতাত্ত্বিক ও সামাজিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। এই দু’টি গ্রন্থের বিষয়বস্তু সমগ্র ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশ সম্পর্কে। কিন্তু ক্ষুদ্রতর পরিসরে চট্টগ্রাম অঞ্চলের এই একটি বিশেষ বিদ্রোহের পটভূমির সমাজতাত্ত্বিক, সামাজিকঅথনৈতিক ও সমাজ কাঠামোর বিশ্লেষণ জরুরিতুলনামূলক বিশ্লেষণ পদ্ধতির মাধ্যমে। বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলন সম্পর্কিত বিভিন্ন তত্ত্বই হবে তাত্ত্বিকাঠামো।

সমাজ বিপ্লব, বিদ্রোহ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সম্পর্কে বিভিন্ন মার্কসীয় ও অমার্কসীয় তত্ত্ব রয়েছে। মার্কসীয় তত্ত্বের মধ্যে লেনিন ও রোজা লুক্সেমবার্গের তত্ত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অমার্কসীয় তত্ত্বের মধ্যে রাইনহার্ট বেনডিক্স, ক্রেনবৃন্টন, ব্যারিংটন ম্যূর ও থেডাস্কোপলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত তত্ত্ব, বিশেষত থেডাস্কোপলের তত্ত্ব আধুনিককালে বিপ্লব ও বিদ্রোহের বিশ্লেষণে নতুন তাত্ত্বিক হাতিয়ার। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের বিশ্লেষণে এই সব তত্ত্বের প্রয়োগ (একক বা যৌথভাবে) কতখানি প্রযোজ্য অথবা এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্রোহ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন একটি মৌলিক তত্ত্বের প্রয়োজন কিনা তা ও বিচার্য বিষয়।

চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, মাস্টারদা সূর্য সেন ও তাঁর সহযোদ্ধাদের কর্মের বিজ্ঞান ভিত্তিক নির্মোহ মূল্যায়ন প্রয়োজন। এ কাজে প্রাথমিক সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা, এ বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের সামাজিক পটভূমি, সামাজিকশ্রেণি সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা, চট্টগ্রামের সমাজ কাঠামো সম্পর্কে চট্টগ্রাম জেলা ভূমি জরিপ, ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার ইতোমধ্যে প্রকাশিত বই, পত্রপত্রিকা, সংশ্লিষ্ট দলিল, মামলার নথি, ইত্যাদি পরীক্ষা করা যায়। তবেই চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ও বিপ্লবীদের কর্মকান্ডের সমাজতাত্ত্বিক ও বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ পাওয়া যাবে।

আইনজীবী পিতার ছেলে বিনোদ বিহারী চৌধুরী (জন্ম: ১০ জানুয়ারি ১৯১১মৃত্যু: ১০ এপ্রিল ২০১৩)। বাবার ভিন্ন পরিকল্পনা ছিল ছেলে কে নিয়ে। কিন্তু যুবক বিনোদ দেশমাতৃকার মুক্তির মন্ত্রে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বিপ্লবী জীবনে আসা প্রসঙ্গে বিনোদ বাবু লিখেন, “ আমার প্রথম দু’বার সাক্ষাতে তিনি [মাষ্টারদা] আমাকে এমনভাবে বিপ্লবী দলে না আসার জন্য উপদেশ দিয়েছেলেন এবং বলেছিলেন, বিপ্লবী দলে না ঢুকে ও দেশের কাজ করা যায়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন ও মহাত্মা গান্ধীর (মোহন দাশ করমচাঁদ) নাম উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, এঁরা কি দেশের স্বাধীনতার জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন না? তুমি বিপ্লবী দলে না এসেও দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করতে পারো। মহাত্মা গান্ধীর মতো মহৎ আদর্শের লোকের কর্মকাণ্ডে নিজেকে সংযুক্ত করতে পারো। শুধু শুধু জেল জুলুম, পুলিশের অত্যাচার বা চরম মূল্য দেবার ঝুঁকি তোমার নেওয়া উচিত হবে না’। মাষ্টারদা এমনভাবে কথাগুলো বলেছিলেন যাতে মনে হবে তিনি আমার ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্যই আন্তরিকভাবে এ উপদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম আইরিশ দেশ ব্রতীদের মতো আমাদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম না করলে ধূর্ত ব্রিটিশ সরকারকে এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আমাকে পরীক্ষা করার জন্যই আমার মনোবল, সাহস ও দেশ প্রেমের গভীরতা পরখ করার জন্যই মাষ্টারদা প্রথম দু’দিন এরকম বিপ্লবী দলে না আসার উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধির আঁচ পেয়ে আমি প্রথম থেকেই আমার বিপ্লবী দলে ঢোকার গভীর আগ্রহের কথা তাঁকে জানিয়েছিলাম’’। (অগ্নিঝরা দিনগুলো, পৃ: ২২)

এভাবে মানুষরূপী স্বপ্নের আরাধ্য দেবতা সূর্য সেনের নেতৃত্বে এই দ্রোহী মানুষগুলোই একদা চট্টগ্রাম রিপাবলিকান আর্মি গঠন করে দীর্ঘ প্রস্তুতি শেষে ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নামে সাধারণ্যে পরিচিত ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বৃটিশ শাসনের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে। বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে এ এক মাইল ফলক। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘Chittagong to the fore’. বৃটিশরা নতুন করে হিসেব নিকেশ শুরু করল। বিনোদ বিহারী চৌধুরী সশস্ত্র যোদ্ধা। গুলি বিদ্ধ হয়েও ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচেছেন। এ প্রসঙ্গে বিনোদ বিহারী চৌধুরীর স্মৃতিচারণ, “ হঠাৎ একটা গুলি, চারদিকে দেখলাম সৈন্যসামন্ত নেই। গলায় তখন অসহ্য যন্ত্রণা। ফোটা ফোটা রক্ত ঝরছে। বিপ্লবীরা লেঙ্গুট ছিঁড়ে আমার গলায় ব্যান্ডেজ করে দিলেন। আমাদের এক ক্লাসফ্রেন্ড রজত সেন। সে বলল, ‘তোর কষ্ট হচ্ছে খুব, না? তোকে তাহলে গুলি করে মেরে দেই?’ তখন শুনছি রজতকে উদ্দেশ্য করে লোক দা ( বিপ্লবী লোকনাথ বল) বলছেন-‘নাও বাঁচবে। ওকে গুলি করতে হবে না। ওকে আমরা নিয়ে যাব’। জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে ১১ জন সহযোদ্ধার মৃত্যু দেখেছেন খুব কাছ থেকে। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ১২ জানুয়ারি সূর্য সেনকে চট্টগ্রাম কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠী। এ সময় সূর্য সেনের ঘনিষ্ঠ সহচর বিনোদ বিহারী সূর্যসেনের মৃত্যুতে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন, আত্মগোপন, গৃহবন্দী ও কারা বরণ করেছেন দীর্ঘ সময়। ১৯৪১ সালে তিনি আবারও গ্রেফতার হন, ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে জেল থেকে মুক্তি পান।

পরবর্তীতে কংগ্রেস রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে কংগ্রেস নেতা হয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ দলীয় দায়িত্ব ও পালন করেছেন। ১৯৪৮ সালে কংগ্রেসের মনোনয়নে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর আয়ুবের সামরিক শাসন জারির পর সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর ভাষায়, “তখনই আমার মনে হয়েছিল, পাকিস্তানে অদূর ভবিষ্যতে কোনো রকম রাজনীতি করা সম্ভব হবে না। আমি রাজনীতি হতে ধীরে ধীরে অবসর গ্রহণ করলাম। তখন জাতীয় কংগ্রেস বেআইনী ঘোষিত হয়েছিল। আমি সেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলাম” (অগ্নিঝরা দিনগুলো, পৃ: ৬০)

আমাদের মহান জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে বিনোদ বাবু কোলকাতায় প্রবাসী সরকারের সমর্থনে ছাত্র যুবাদের উদ্বুদ্ধকরণ, শিশুদের শিক্ষাদান ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। পেশাগত জীবনে কিছুদিন দৈনিক পাঞ্চজন্য পত্রিকায় সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আইন শাস্ত্রে ডিগ্রি নিয়েও আইনপেশায় স্থিত হননি। শিক্ষকতা করেছেন নিজ গৃহে ছাত্র পড়িয়ে। সাধারণ্যে তিনি ‘মাষ্টার মশায়’ (মহাশয়) নামেই পরিচিত। মাষ্টারদা সুর্য সেনের সহযোদ্ধা ‘মাষ্টার মশায়’ বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। লক্ষণীয় গত শতাব্দীর বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ তিনটি ঘটনা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান গৌরবের। কোনো উচ্চভিলাষ নেই ‘সেবাই ব্রত’। একজন নিবেদিত প্রাণ সমাজসেবী। দেশ বিদেশ থেকে সম্মাননা/পুরস্কার পেয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। সমাজসেবী হিসেবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা দিবস পদক ২০০০’ এ ভূষিত হয়েছেন। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সেবামূলক অনেক সংগঠনের কর্ণধার, প্রাণপুরুষ তিনি। বিনোদ বাবুর দুই ছেলে সুধীর চৌধুরী এবং বিবেকানন্দ চৌধুরী পরলোকে। কোলকাতার বাসিন্দা বিবেক বিয়ে করেছিলেন আরেক বিপ্লবী শ্রী শচীন গুহের মেয়ে উপালী চৌধুরী শান্তুকে। একমাত্র নাতি স্থপতি সৌম শুভ্র চৌধুরী বীরু। বিনোদ বাবুর সহধর্মিণী শ্রীমতী বিভা চৌধুরী আমার স্ত্রীর প্রিয় শিক্ষিকা বেলা দিদিমণি পরলোক গমন করেছেন ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ সোমবার। বিনোদ বিহারী চৌধুরী অত্যন্ত সাদাসিধে বিনয়ী ভদ্রলোক। অতি সাধারণ ঘরদোর, জীবনাচার ও বেশভূষা। ন্যায় নিষ্ঠ হিতবাদী চিন্তা চেতনার এক অসাধারণ মানুষ। প্রায়শঃ ক্ষেত্রে রাজনীতিতে কিংবা সমাজ সেবকের ইদানীং যে চরিত্র ও চিত্র আমরা পাই বিনোদ বিহারী চৌধুরী সে দলের নয়। ভোগের নয় ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। পরার্থে নিজেকে নিবেদিত রাখাই তাঁর জীবনের ব্রত। জয়তু বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী!

লেখক: সমাজ বিজ্ঞানী ও সিনেট সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান ঘাসফুল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর
পরবর্তী নিবন্ধইডিএফ ঋণের সীমা কমলো ৫০ লাখ ডলার