চট্টগ্রাম মহানগরীর সামগ্রিক উন্নয়ন ভাবনা

শাহেদ আলী টিটু | বুধবার , ২৩ জুলাই, ২০২৫ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

মহানগরীর মোট ৪১ টি ওয়ার্ড ও ১৬টি থানা নিয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা। প্রতিটি ওয়ার্ডে দেখা যায় রাস্তাগুলো সরু এবং যাওয়া আসার প্রবেশপথ অপ্রশস্ত। রাস্তার জায়গা দখল করে তৈরি হয়েছে ঘরবাড়ি এবং অবৈধ দোকানপাট। এতে করে নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, এ্যাম্বুলেন্স নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে না অনেক এলাকায়। মহানগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডের চিত্র প্রায় একই রকম। যে সমস্ত ওয়ার্ডে রাস্তার জায়গা এনক্রসমেন্ট হয়ে গেছে সেসব জায়গা সিডিএ এবং সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করে জরুরি ভিত্তিতে পুনরুদ্ধার করতে হবে। নগরীতে বেশীর ভাগ ট্রাফিক কনজেশন এর কারণ রাস্তার মোড়ে অবৈধ গাড়ি পার্কিং। এছাড়াও ইন্টারসেকশনগুলোতে পাবলিক বাসগুলো যাত্রী ওঠানামা করে। রাস্তার ইন্টারসেকশনগুলো ডিজাইনের মধ্যে যদি গাড়ী দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানামার জন্য আলাদা লেইন করে গাড়ি দাঁড়ানোর একটা কর্ণার করা যায়, তাহলে গাড়িগুলো রাস্তার মোড়ে না দাঁড়িয়ে ঐসব নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করবে।

নিরাপদ রাস্তা পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিংসহ অটোমেটিক সিগন্যাল লাইটিং ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অক্সিজেন মোড়, ২ নং গেইট জিইসি সার্কেল এবং দেওয়ানহাট, ও সি ইপিজেড মোড়ে ফুট ওভার ব্রীজ এর পরিবর্তে রাস্তা পারাপারের জন্য আন্ডার পাস এর ব্যবস্থা করা যায়। কয়েকটি কাউন্টারভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু হলেও তা যথেষ্ট নয়। কোম্পানি বাস সার্ভিসগুলো নির্দিষ্ট স্থানে টিকেট কাউন্টার স্থাপন করলে রাস্তার শৃংঙ্খলা ফিরে আসবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর সাথে জার্মান ও মিশরভিত্তিক কোম্পানী ওরাসকম কনস্ট্রাকশন এবং আরব কন্ট্রাক্টর এর মধ্যে নগরীতে ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩টি লাইনে মোট ৫৪ কিলোমিটার মনোরেল নির্মাণের জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় সম্প্রতি। এই মনোরেল চালু হলে সড়কের ওপর বাড়তি চাপ কমবে এবং চলাচলের জন্য মানুষ বিকল্প যাতায়াত ব্যবস্থা খুঁজে পাবে। চট্টগ্রাম নগরীতে আরও একটি বিকল্প যাতায়াত ব্যবস্থা হতে পারে নগরীর খালসমূহে ইঞ্জিনচালিত যাত্রী সাম্পান। অপরদিকে খালসমূহে নিয়মিত ইঞ্জিনচালিত সাম্পান চলাচলের ফলে ময়লাআবর্জনা মুক্ত থাকবে এবং অবৈধভাবে খালের জায়গা দখল করে ঘরবাড়ী, দোকান পাট নির্মাণ করতে পারবে না। চট্টগ্রাম মহানগরীর ১২৫ কিলোমিটার প্রাকৃতিক খালে এলাকাভেদে জরিপ করে ইঞ্জিনচালিত যাত্রী সাম্পান চালু হলে যাত্রীদের মধ্যে সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

নগরীর প্রধান সড়ক গুলোতে স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের ফলে পিক আওয়ারে অফিসগামী মানুষজনের যথেষ্ট সময় অপচয় হচ্ছে। স্কুলের সম্মুখ সড়কে ছুটির সময় কিংবা স্কুল আরম্ভ হওয়ার সময় যানজট থাকে। আবার ক্লিনিক কিংবা হাসপাতালগুলোর সামনের সড়কেও একই রকম চিত্র দেখা যায়। বেশিরভাগ হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক চট্টগ্রাম শহরের প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত। বর্তমানে যেসব হাসপাতালের অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেগুলোতে নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা রাখা জরুরি। মেহেদীবাগ ম্যাঙ হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতাল প্রধান সড়কের ওপর এবং ল্যাব এইড, সিএসসিআর, শেভরন ডায়াগষ্টিকসহ আরও কিছু হসাপাতাল রাস্তার ওপরে। যে কারণে সন্ধ্যার সময় প্রতিদিন এই সমস্ত সড়কে যানজট লেগেই থাকে এবং কিছু গাড়ী রাস্তার পাশে পার্কিং করে রাখে। আর কিছু ফুটপাত দখল করে অস্থায়ীভাবে দোকান স্থাপন করা হয়েছে যার কারণে পথচারীগণ ফুটপাত ব্যবহার না করতে পেরে রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হয়। তাছাড়া বহু স্থানে পথচারীদের জন্য রাস্তা পারাপার এর বিষয়টি একটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই রকম পরিস্থিতি অঙিজেন মোড়, জিইসি সার্কেল সহ নগরীর অনেক রাস্তায়। এই ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা পারাপার থেকে পথচারীদের নিরাপদ পারাপার নিশ্চিত করতে হলে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

আবার অঙিজেন মোড় থেকে ফতেয়াবাদ পর্যন্ত রাস্তাটিও অপ্রশস্ত। এই রোডে প্রচুর যানবাহনের চাপ। এই সড়কে বড় দিঘীর পাড় থেকে প্রায় সময় ট্রাফিক জ্যাম লেগে থাকে। এখন ফতেয়াবাদ পর্যন্ত শহর সম্প্রসারণের মাস্টার প্ল্যান করা হচ্ছে। উন্নত দেশে দেখা যায়, হঠাৎ কোন পথচারীকে রাস্তা পারাপার হতে দেখলে গাড়ির চালক গাড়ি থামিয়ে পথচারীকে যাতায়াতের সুযোগ দেয়। কিন্তু আমাদের দেশের চালকদের এত ধৈর্য নেই। তারা ট্রাফিক জ্যামে থাকলে সেখানেও হর্ণ বাজাতে থাকে। অথচ অন্য কোন দেশে আপনি গাড়ির হর্ণ শুনতে পাবেন না। এখন এই সব শব্দ দূষণ নগরীতে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কোন কোন বাড়ীতে অসুস্থ রোগী, বৃদ্ধ মাবাবা, দাদাদাদী থাকেন আবার পরীক্ষার্থী থাকেন। শিশুদের স্কুল যেতে হয় সকালে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গাইনাইজেশনের সুপারিশ অনুযায়ী একজন স্বাভাাবিক মানুষের দিনের বেলায় শ্রবণ সক্ষমতা ৫৫ ডেসিবেল, রাতের বেলায় ৪৫ ডেসিবেল। কিন্তু গড়পড়তা শব্দ দূষণের মাত্রা হলো ৭৫ ডেসিবেল। যা অনেক বেশি। শব্দ দূষণের সাথে বায়ু দূষণের মাত্রাও মারাত্মক। গাড়ির কালো ধোঁয়া, কলকারখানার নির্গত ধোঁয়া ও রাস্তার ধুলোবালির কারণে বায়ু দূষিত হচ্ছে। যা মানুষের স্বাস্থ্যহানিসহ নানাবিধ রোগের অন্যতম কারণ।

লালখান বাজার থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ফ্লাইওভার গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন এই ফ্লাইওভার ব্যবহার করা গাড়ীর সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। আগ্রাবাদের মত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় এয়ারপোর্ট আসা যাওয়ার জন্য সরাসরি কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আগ্রাবাদ জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সামনে র‌্যাম্প নামানোর কথা থাকলেও তা পরে বাতিল করা হয়। অথচ আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অফিস, ব্যাংক ও শিপিং এজেন্ট, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিকমানের হোটেল, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি, উইম্যান চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি। যেখানে দেশিবিদেশী কুটনীতিক, মন্ত্রী ও উপদেষ্টাগণ, সরকারি আমলা এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও বিনিয়োগকারীগণ প্রতিনিয়ত আসা যাওয়া করেন। সুতরাং আগ্রাবাদ এলাকা থেকে একটি উঠার জন্য র‌্যাম্প এবং এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি নামার জন্য একটি র‌্যাম্প নির্মাণ করা জরুরী। বর্তমানে চট্টগ্রাম ইপিজেডহালিশহর, পতেঙ্গাবাসীর জন্য আরেকটি বড় মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের ২ নং জেটি গেইট, ৪ নং জেটি, ৫ নং জেটি এবং এমপিবি গেইট থেকে সল্টগোলা রেলক্রসিং পর্যন্ত লাগাতার ট্রাফিক জ্যাম। এটি এখন নিত্যদিনের ব্যাপার।

চট্টগ্রাম বন্দরে ট্রাক কাভার্ডভ্যান যাতায়াতের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে আলাদা সড়ক তৈরি করা যেতে পারে। ফলে যানজট থেকে মুক্তি পাবে এসব এলাকার জনসাধারণ। চট্টগ্রাম শহরের আরেকটি সড়ক বলা যায় একেবারই যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে থাকে সারাবছর। সদরঘাটমাঝিরঘাট সড়ক। বহির্নোঙ্গর থেকে লাইটার জাহাজে করে বিভিন্ন আমদানিকৃত পণ্য সদরঘাট জেটিতে ভিড়ে আর এসব জেটি থেকে ট্রাক কিংবা কাভার্ডভ্যানে করে পণ্যগুলো নগরীর বিভিন্ন গুদামে চলে যায়। এখানেও তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যেহেতু এটা বন্দর এলাকা তাই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং যানজট নিরসনের জন্য অবশ্যই বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০০০ গাড়ি প্রবেশ করে বন্দরে। মাত্র ৩% কার্গো পরিবহন হয় রেলপথে এবং ৪% পানি পথে। সুতরাং সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই রেলপথে এবং পানি পথে পরিবহনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

বেটার্মিনাল চালু হলে তখন পরিবহনের চাপ আরোও বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে যে সড়ক রয়েছে এসব সড়কের সক্ষমতা কতটুকু আছে কিংবা তখন কি পরিবহন গাড়ি যাতায়াত করবে তার একটা আনুমানিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তা ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যদিও বেটার্মিনালের অবস্থান পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের কাছে আনন্দবাজার এলাকায়। বেটার্মিনাল নির্মাণ পরবর্তী চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে বহুগুণ। সেসব চাপ মোকাবেলায় সড়ক নেটওয়ার্ককে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমের গতি মন্থর হয়ে যেতে পারে। তাই এখনই এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যান করা জরুরি।

লেখক : উপসচিব, সিসিসিআই

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধসেপাক টাকরো কিংস কাপে বাংলাদেশের জয়