চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ শাখার অনিয়ম অনুসন্ধানে নতুন করে কাজ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কর্ণফুলী উপজেলা কমপ্লেক্সের জমি অধিগ্রহণ প্রকল্পে নিয়োজিত এক সার্ভেয়ারের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে দুদক জানতে পারে, সার্ভেয়ারের মর্জিতেই স্থান নির্ধারিত হয় নতুন নতুন প্রকল্পের। এ নিয়ে সুনীল কান্তি দেব মহাজন নামের ওই সার্ভেয়ারের পাশাপাশি প্রকল্পের অনিয়মে জড়িত স্থানীয় দুই পিতা-পুত্রের সংশ্লিষ্ট নথি তলব করেছে দুদক। জানা গেছে, কর্ণফুলী দেশের সর্বশেষ অনুমোদিত উপজেলা। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উপজেলা প্রশাসনের কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ৬ একর জমি অধিগ্রহণের পদক্ষেপ নেয় জেলা প্রশাসন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, অধিগ্রহণকৃত বেশিরভাগ জমি স্থানীয় আবদুস ছালাম ও তার ছেলে ওয়াসিমের নামে আমমোক্তার ও খরিদকৃত। তারাই জেলা প্রশাসন থেকে অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ চেক গ্রহণ করেছে। এ নিয়ে ২০১৯ সালের শুরুতে একটি অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। ওই অভিযোগে প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের (এলএ মামলা নং- ৩০/১৭-১৮) জন্য প্রস্তাবিত প্রকল্প স্থান নির্ধারণ নিয়ে যোগসাজশ ও অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পের সাথে জড়িত সার্ভেয়ার সুনীল কান্তি দেব মহাজন অনিয়ম দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদের মালিক বনেছেন। পরবর্তীতে দুদক প্রধান কার্যালয় অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। সম্প্রতি অভিযোগটির অনুসন্ধানে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলমকে প্রধান করে দুই সদস্যের টিম গঠন করা হয়।
অনুসন্ধানে নেমে দুদক জানতে পারে, কর্ণফুলী উপজেলা কমপ্লেক্স করার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত কমমূল্যের জমি থাকায় শাহমীর মৌজায় কমপ্লেক্স করার প্রস্তাব হয়। কিন্তু ওই প্রস্তাবের পর সার্ভেয়ার সুনীলসহ কয়েকজনের যোগসাজশে স্থান পরিবর্তন করা হয়। স্থানীয় আবদুস ছালাম, তার ছেলে ওয়াসিম ও তাদের নিকটাত্মীয় আইয়ুবের নামে আমমোক্তার ও খরিদকৃত স্থানে অধিগ্রহণের স্থান নির্ধারণ করা হয়।
স্থানীয় কয়েকজনের অভিযোগ, কর্ণফুলী উপজেলা কমপ্লেক্সের ভূমি অধিগ্রহণে সার্ভেয়ার ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা যোগসাজশ করে কয়েক কোটি টাকা সরকারি অর্থের তসরুপ করেছেন। স্থানীয় আলী হায়দার নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, কর্ণফুলী উপজেলা কমপ্লেক্সের জমি অধিগ্রহণে আমার খরিদা জমিও পড়েছে। অথচ আবদুস ছালামের সাথে যোগসাজশ করে আমার জমি অধিগ্রহণের বাইরে বলে প্রতিবেদন দিয়েছে সার্ভেয়ার। কার্যত উপজেলা কমপ্লেক্স প্রকল্পের মধ্যে আমার জমিও পড়েছে। আমি এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনে অভিযোগ করেছি। আমার মতো আরো অনেকে তাদের হয়রানির শিকার হয়েছেন। স্থানীয় বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জমির আমমোক্তার নিয়ে নিয়েছে তারা।
এদিকে অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে দুদকের অনুসন্ধানকারী টিম বক্তব্য জানতে নোটিস দিলেও হাজির হননি আবদুস ছালাম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার সুনীল কান্তি দেব মহাজনের বিষয়ে বক্তব্য জানতে কর্ণফুলীর শিকলবাহা ইউনিয়নের আবদুস ছালামকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বক্তব্য দিতে দুদকে হাজির হননি। পরবর্তীতে আবদুস ছালাম ও তার ছেলে ওয়াসিমের নামে চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ শাখা হতে যতগুলো চেক ইস্যু হয়েছে, সবগুলোর পেমেন্ট নথি চাওয়া হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসন থেকে এসব নথি এখনো দেওয়া হয়েছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারেননি এ কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে সোমবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে জানতে চাইলে আবদুস ছালাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমি কিছুই জানি না, আমি বয়স্ক মানুষ। সুনীল বাবু (সার্ভেয়ার) গরীব মানুষ। তার বিরুদ্ধে আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না। আমার বিল্ডিংয়ে পুরো উপজেলা। আমাকে তারা (উপজেলা প্রশাসন) ভাড়াও দেয় না।
তিনি বলেন, কর্ণফুলী উপজেলায় আমার ৮০ কানি সম্পত্তি আছে। অধিগ্রহণে সব আমার জায়গা। আমার বাবা জায়গা কিনেছে, আমার দাদা জায়গা কিনেছে, আমি জায়গা কিনেছি, আমার ছেলেরাও কিনেছে। আমার ছেলেরাও বলতে পারে না, তাদের নামে জায়গা কিনেছি। কানি জমি ৬০ হাজার টাকা যখন ছিল, তখন থেকে কিনছি। এখন গণ্ডা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। অধিগ্রহণ হওয়াতে আমি আরো লোকসানে পড়েছি। কারণ রাস্তার পাশের জায়গা আমি গণ্ডা ২০ লাখ টাকা করে পেতাম। এখন পেয়েছি ১০-১২ লাখ টাকা করে।
ভুক্তভোগী আলী হায়দারের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ওর বাবা ওই জায়গা অন্য লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। বাবা বিক্রি করে দিলে ছেলে তো সম্পত্তি পায় না। ভূমি অফিসের তদন্তেও তার জায়গা পাওয়া যায়নি।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে সার্ভেয়ার সুনীল কান্তি দেব মহাজনের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ থাকায় কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) বদিউল আলম সোমবার বিকেলে দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। এখনও সব কর্মচারীদের সাথে পরিচয় হয়নি। সার্ভেয়ার সুনীলের বিষয়ে দুদক থেকে কোন নথি চাওয়া হয়েছে কিনা, জানি না।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৭ নভেম্বর নগরীর শপিং কমপ্লেক্স থেকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার চেইনম্যান নজরুল ইসলামকে নগদ সাড়ে ৭ লাখ টাকা এবং সাড়ে ৯১ লাখ টাকার ১০টি এলএ ক্ষতিপূরণ চেকসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে দুদক। এরপর নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা হলে তার বেশ কয়েকটি ব্যাংক হিসাব ও একটি ফ্ল্যাট জব্দ করে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা। পরে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা হয় নজরুল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে।