(পূর্ব প্রকাশের পর)
আমার আমন্ত্রণে, কক্সবাজার থেকে নির্বাচিত এম.এল.এ, (পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য) গিয়াস উদ্দীন আহমদ চৌধুরী, হাটহাজারী থেকে নির্বাচিত এম.এল.এ,আবুল খায়ের সিদ্দিকী এবং চান্দগাঁও-বোয়ালখালী থেকে নির্বাচিত এম.এল.এ, শরাফতুল্লাহ এই সমাবেশে যোগদান করেন এবং ‘আন্দোলনের দাবীর’ প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। আমার আমন্ত্রণের সময়ে উপস্থিত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও- পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার তদানিন্তন বিরোধী দলের নেতা এ,কে,এম, ফজলুল কবির চৌধুরী (রাউজানের বাসিন্দা) ঐ সমাবেশে যোগদান করেননি। আমাকে সভাপতি ও আহ্বায়ক মনোনীত করে ছাত্রদের বক্তৃতা শেষে, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটি’ সর্বসম্মতিক্রমে গঠিত হওয়ার পরে আমি যখন সভাপতির সমাপনী বক্তব্য রাখছিলাম ঠিক সেই সময়ে, কায়সার ভাই ঐ সমাবেশে উপস্থিত হন। আমি তৎক্ষণাৎ তাঁকে, গঠিত ‘সংগ্রাম কমিটির’ যুগ্ম-আহ্বায়ক হওয়ার অনুরোধ জানালে তাতে তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে ঢাকার প্রতিটি পত্রিকা অফিসে গিয়ে, উপরোল্লিখিত ‘সমাবেশের’ তথ্য আগেভাগেই অবহিত করে রেখেছিলাম। সমাবেশ অনুষ্ঠানের পরবর্তী দিনে, প্রতিটি দৈনিক পত্রিকা, দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক মর্নিং নিউজ, দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার-আমাদের ঐ সমাবেশের খবর প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে প্রকাশ করে। ঐ সমাবেশে নিম্নলিখিত চট্টগ্রামবাসী ছাত্রদের সমন্বয়ে নিম্নোক্তরূপে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয় :
১। জসীম উদ্দীন হায়দার চৌধুরী-আহ্বায়ক; ২। আতাউর রহমান খান কায়সার-যুগ্ন আহ্বায়ক; ৩। ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী-সাধারণ সম্পাদক; ৪। মোহাম্মদ ইদ্রিস চৌধুরী-যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক; ৫। আবুল ফজল চৌধুরী-সাংগঠনিক সম্পাদক; ৬। মোহাম্মদ হোসেন খান- প্রচার সম্পাদক, ৭। এ.কে.এম সামসুল ইসলাম-কোষাধ্যক্ষ; সদস্য- ৮। মোহাম্মদ নুরুল হুদা, ৯। জিয়াউদ্দীন মাহ্মুদ, ১০। এ.কে.এম বজলুল করিম চৌধুরী, ১১। বাদল বরণ বড়ূয়া, ১২। আমিনুল ইসলাম বেদু ১৩। আহ্মদ ছফা।
এই ‘কমিটিতে’ অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবৃন্দ সকলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়নরত মাস্টার্স ও সম্মান শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। শিক্ষা-জীবনের পরবর্তীতে, তাঁদের নিজেদের প্রতিভা ও যোগ্যতার গুণে, তাঁরা অত্যন্ত সম্মানিত ও গৌরবজনক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তাঁদের প্রশংসনীয় অর্জন ও কৃতিত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁরা চট্টগ্রামের জনসমাজ তথা দেশবাসীর কাছে স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তবে দুঃখের বিষয়, তাঁদের অধিকাংশই এখন প্রয়াত। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সহায়তা কামনার লক্ষ্যে, ‘সংগ্রাম কমিটি’ ঢাকায় উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ ও প্রভাবশালী পদে কর্মরত চট্টগ্রামের বাসিন্দা বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে, পর্যায়ক্রমে, আতাউর রহমান কায়সারের নেতৃত্বে, দলবদ্ধভাবে সাক্ষাত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
(ক) একদিন সন্ধ্যার পরে, কায়সার ভাইয়ের নেতৃত্বে, দলবদ্ধভাবে আমরা পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী শ্রীমতি বিনীতা রায় এবং সুলতান আহমদের সঙ্গে, পরপর পৃথকভাবে, আব্দুল গণি রোডস্থিত (ঢাকায়) তাঁদের দ্বিতল বিশিষ্ট সরকারি বাসভবনে দেখা করতে যাই। তাঁরা উভয়ে আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং আশ্বাস দেন যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে সাক্ষাত হলে তাঁরা অবশ্যই চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা তাঁকে বলবেন। মন্ত্রী সুলতান আহমদ আমাদের জন্য ব্যয়বহুল নৈশ-ভোজের আয়োজন করেন।
(খ) ঢাকায় কাকরাইল রাস্তার মোড়ে অবস্থিত দ্বিতল ভবনটি এখন যেটা বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবন সেটা তখন ছিল ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবন।
এক তারিখে রাত্রি বেলায় সেখানে গিয়ে হাইকোর্টের তদানিন্তন প্রধান বিচারপতি (চট্টগ্রামের মীরসরাই থানার বাসিন্দা) ইমাম হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। তাঁর ভবনের নীচ তলার ড্রয়িং রুমে (দাঁড়ানো অবস্থায়) আমাদেরকে, অনুরোধক্রমে, সাক্ষাত প্রদান করেন এবং বলেন যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তিনি চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তাঁকে অনুরোধ জানাবেন।
(গ) ১৯৫৬ সনে প্রবর্তিত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৬২ সনে আইয়ুব খানের প্রণীত পরবর্তী সংবিধানে বলা হয় যে, এই দুই ভাষার অধিকতর উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সাধনের জন্য গবেষণার লক্ষ্যে দুটি পৃথক ‘ভাষা উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন করা হবে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা গঠিত ‘বাংলা ভাষা উন্নয়ন বোর্ডের’ পরিচালক নিযুক্ত হন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ভূজপুর গ্রামের কৃতি সন্তান, খ্যাতনামা সাহিত্য গবেষক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ এনামুল হক। ইনি ছিলেন-রাশ-ভারী, গম্ভীর প্রকৃতির এবং একেবারেই স্বল্পভাষী মানুষ। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সভাপতিত্বে ‘‘ভাষা-উন্নয়ন বোর্ড’ দু’টির সভা হতো পাকিস্তানের অস্থায়ী রাজধানী রাওয়ালপিন্ডিতে। বাংলা-ভাষা উন্নয়ন বোর্ডের কার্যালয় স্থাপিত হয়েছিল-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনের বিপরীতে রাস্তার উত্তর পাশে একটি বড় দ্বিতল ভবনে। একদিন অপরাহ্নে, ড. এনামুল হকের সঙ্গে দেখা করতে আমরা সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি, সমস্ত ভবনটি সুন্সান নীরব-নীচে একটি গাড়ি, ড্রাইভার এবং একজন দারোয়ান ছাড়া আর কেউ নাই। দালানের দোতলায় পূর্ব-মুখী বারান্দায় নিখুঁত স্যুট পরিহিত ড. হক একটি ইজি চেয়ারে নীরবে একা বসে আছেন। চেয়ারে বসে থেকেই আমাদের দিকে না তাকিয়ে নিঃশব্দে আমাদের বক্তব্য শুনলেন এবং শুধু একটি মাত্র বাক্যে বললেন-সাক্ষাত হলে (প্রেসিডেন্টের সঙ্গে) চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা তাঁকে বলবেন।
(ঘ) চট্টগ্রাম শহরের মোহরার অমর কীর্তিমান সন্তান, এ.কে খান, এই নিবন্ধের আলোচ্য সময়ে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প ও বেসামরিক বিমান পরিবহন দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচার বিমুখ ও শান্ত স্বভাবের স্বল্পভাষী মানুষ। ১৯৬৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে একদিন তিনি পরিবারের সদস্যবর্গসহ ঢাকা থেকে বিমান যোগে রাওয়ালপিন্ডি যাচ্ছিলেন। খবর পেয়ে, কায়সার ভাই আমাদেরকে নিয়ে ছুটে গিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরের (ঢাকার পুরাতন বিমান বন্দর) ‘প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে’ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। মন্ত্রী মহোদয় দৃঢ়তার সঙ্গে আমাদেরকে আশ্বস্ত করে বলেন যে, চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছে জোরালো আবেদন রাখবেন।
(ঙ) বোয়ালখালী খরণদ্বীপ গ্রামের বাসিন্দা, আলী আহমদ (BCS) তখন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের বোর্ড অব রেভেনিউ-এর চেয়ারম্যান। তিনি ব্রিটিশ আমলের ‘বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের’ লোক ছিলেন। পাকিস্তান আমলে তিনি ঢাকার জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন। স্থানীয়ভাবে, তিনি ‘আলী আহমদ কমিশনার’ নামে পরিচিত ছিলেন। কায়সার ভাইয়ের নেতৃত্বে এক তারিখে, রাত্রী বেলায়, আমরা তাঁর মিন্টো রোডস্থিত (ঢাকায়) সরকারি বাসভবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি তাঁর ভবনের দোতলায় আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানান এবং মনযোগ সহকারে আমাদের বক্তব্য শোনেন। অতঃপর সেখানে উপস্থিত তাঁর বড় মেয়ে, চিত্রশিল্পী আসমা কিবরিয়ার সঙ্গে (শহীদ অর্থ মন্ত্রী এস.এম.এস, কিবরিয়ার সহধর্মিণী) আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন। আসমা তখন পাকিস্তানে মশহুর মহিলা চিত্রশিল্পী। স্বামীর ফরেন সার্ভিসের সুবাদে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানের দূতাবাসগুলিতে তাঁর চিত্রকর্মের ‘প্রদর্শনী’ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল।
তিনি জানালেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে তাঁর দেখা-সাক্ষাতের ভালো সম্ভাবনা আছে। তিনি আশ্বস্ত করলেন যে, স্বামীর সিলেট জেলার পরিবর্তে, বাবার চট্টগ্রাম জেলায় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে বলবেন। চট্টগ্রামের পটিয়া থানার অন্তর্গত জিরি গ্রামের কৃতীসন্তান এবং পাকিস্তান আমলের স্বনামধন্য সি.এস.পি, অফিসার, এ.কে.এম, আহসান তখন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের সমবায় অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। সাপ্তাহিক এক ছুটির দিনে, বিকাল বেলায় আমরা ইস্কাটনস্থিত (ঢাকায়) তাঁর সরকারি বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করি। তিনি ধৈর্য্য সহকারে আমাদের বক্তব্য শোনেন এবং বলেন যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সম্ভাবনা ‘নিশ্চিত নয়’ তবে সুযোগ পেলে, তিনি অবশ্যই প্রেসিডেন্টকে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুরোধ জানাবেন।
(চলবে)