চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের খরচ বাড়ল ৪১ শতাংশ

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের খরচ বেড়ে গেল। বন্দরের ট্যারিফ গড়ে ৪১ শতাংশ বাড়িয়ে রোববার রাতে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। গতকাল সোমবার থেকে বর্ধিত হারে ট্যারিফ কার্যকর করা হয়েছে। কন্টেনার হ্যান্ডলিং, কার্গো খালাস, জাহাজ চলাচল, পাইলটেজ ও টাগ সার্ভিস, পানিবিদ্যুৎ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ক্রেন ও যন্ত্রপাতি ভাড়া, গেটপাস ও লাইসেন্স নবায়নসহ বন্দরের সব সেবাখাতে ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ব্যবসায়ী শিল্পপতিসহ বন্দর ব্যবহারকারীদের আপত্তির মুখে সরকার এই ট্যারিফ বৃদ্ধি করল। ইতোপূর্বে বন্দর ব্যবহারকারীদের সাথে আলোচনাকালে প্রস্তাবিত ট্যারিফ নিয়ে কিছুটা বিবেচনা করার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত রোববার রাতে প্রস্তাবিত ট্যারিফে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধি নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে আলোচনা চলে আসছিল। বন্দর ট্যারিফ বৃদ্ধির ব্যাপারে অনড় থাকলেও বন্দর ব্যবহারকারীরা এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তাবিত ট্যারিফ গত ২৪ জুলাই অনুমোদন দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই সময় বন্দর ব্যবহারকারীরা এর তীব্র বিরোধিতা করেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) . সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বৈঠক করেন বন্দর ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ওই বৈঠকে বন্দর ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে এক লাফে বিপুল পরিমাণ ট্যারিফ না বাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু বন্দর ব্যবহারকারীদের অনুরোধের ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা না নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত ট্যারিফের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নেতৃবৃন্দ। তারা বলেন, এভাবে ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের সাধারণ ভোক্তাদের ওপর বর্ধিত ট্যারিফের চাপ পড়বে।

সূত্র বলেছে, বর্ধিত ট্যারিফের সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ছে কন্টেনার পরিবহনে। এখন থেকে প্রতিটি ২০ ফুটি কন্টেনারের জন্য অতিরিক্ত ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা দিতে হবে। আগে যেখানে প্রতি কন্টেনারের ট্যারিফ ছিল গড়ে ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১৬ হাজার ২৪৩ টাকায়। অর্থাৎ প্রতিটি কন্টেনারে মাশুল বাড়ছে গড়ে ৩৭ শতাংশ। আমদানি পণ্যবোঝাই কন্টেনারে অতিরিক্ত খরচ হবে ৫ হাজার ৭২০ টাকা এবং রপ্তানিতে ৩ হাজার ৪৫ টাকা।

কন্টেনার হ্যান্ডলিং খাতে খরচ অনেক বেড়ে যাবে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, আগে এই সেবার জন্য দিতে হতো ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৬৮ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন হাজার টাকা বাড়তি গুণতে হবে শুধু এই খাতে। কন্টেনার ছাড়াও সাধারণ পণ্যের মাশুল বেড়েছে। আগে প্রতি কেজিতে দিতে হতো ৩৫ পয়সা, এখন থেকে দিতে হবে গড়ে ৪৯ পয়সা, যা ১৪ পয়সা বা প্রায় ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

নতুন এই ট্যারিফে জাহাজের পাইলটেজ, টাগ, বার্থিং, কন্টেনার হ্যান্ডলিং, গেটপাস ও বিভিন্ন লাইসেন্স ফিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। পাইলটেজের ন্যূনতম চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০০ মার্কিন ডলার। ১০ হাজার গ্রস টনের বেশি জাহাজের জন্য অতিরিক্ত প্রতি টনের জন্য ০.০৮ মার্কিন ডলার হারে ভ্যারিয়েবল চার্জ দিতে হবে। রাতের বেলায় জাহাজ চলাচল করলে ২৫ শতাংশ বাড়তি চার্জ, বাতিল করলে ২০০ মার্কিন ডলার জরিমানা গুণতে হবে। টাগ সার্ভিস বন্দর চ্যানেলের ভেতরে নিলে (২০০ থেকে ৫,০০০ টন জাহাজের জন্য) চার্জ হবে ৬১৫ ডলার, বাইরে নিলে ১,২৩০ ডলার। বড় জাহাজের ক্ষেত্রে এ খরচ সর্বোচ্চ ৬,৮৩০ ডলার পর্যন্ত উঠবে।

এফসিএল কন্টেনারের (ফুল কন্টেনার লোড) লোড/আনলোড চার্জ ২০ ফুটি কন্টেনারের জন্য ১০২ মার্কিন ডলার, ৪০ ফুটের বেশি হলে ১১৫ ডলার। এলসিএল (লুস কন্টেনার লোড) চার্জ সর্বোচ্চ ৩৪৪ ডলার পর্যন্ত উঠবে। খালি কন্টেনার হ্যান্ডলিং চার্জ ৫১ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বা বিপজ্জনক পণ্য বহনকারী কন্টেনারে ২০০ শতাংশ অতিরিক্ত চার্জ প্রযোজ্য হবে। ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য পরিবহনকারী জাহাজের জন্য অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ, ডেথ ভ্যাসেলের জন্য অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ, অতিরিক্ত অবস্থানের জন্য প্রতিদিন ৫ শতাংশ হারে বাড়তি ট্যারিফ আদায় করা হবে।

বন্দরের অভ্যন্তরে ভারী যানবাহনের প্রবেশ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ টাকা এবং হালকা যানবাহনের জন্য ১২০ টাকা। মোটরসাইকেল বা অটোরিকশার মতো ছোট পরিবহনের জন্য ফি হবে ১০০ টাকা প্রতি প্রবেশে। স্থায়ী গেটপাসের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১,১৫০ টাকা। শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের লাইসেন্স ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ ডলার, আর বার্ষিক নবায়ন ফি ২৫০ ডলার। ভেন্ডর লাইসেন্স ৫০ ডলার, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও শিপিং এজেন্টের জন্য ১০০ ডলার। অফডক বা প্রাইভেট ডিপোর জন্য লাইসেন্স ফি সর্বোচ্চ ১,০০০ ডলার নির্ধারিত হয়েছে।

প্রজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে গড়ে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধির ব্যাপারটি নিশ্চিত করে বন্দর ব্যবহারকারীরা বলেছেন, এক লাফে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধি ব্যবসাবাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অবশ্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৮৬ সালের পর ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে। নতুন ট্যারিফ না বাড়িয়ে বন্দরের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে উঠেছিল। নতুন এই হার কার্যকর হলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় এখনও বাংলাদেশের বন্দর খরচ অনেক কম বলে বন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাক শিল্প। কারণ কাঁচামাল আমদানির সময় এক দফা এবং তৈরি পণ্য রপ্তানির সময় আরেক দফা মিলে মোট দুই দফায় বাড়তি মাশুল গুনতে হবে।

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রামের সভাপতি ও বিজিএমইএর পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব ট্যারিফ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক আখ্যায়িত করে বলেন, এতে রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাবে। ট্রাম্প প্রশাসনের ট্যারিফ নিয়ে পোশাক শিল্প খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে। পোশাক শিল্পের সাথে জড়িতরা নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করছেন। এর মধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ যে হারে ট্যারিফ বাড়িয়ে দিয়েছে তাতে বন্দর হয়তো লাভবান হবে, কিন্তু দেশের প্রতিটি শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই বর্ধিত ট্যারিফ পোশাক শিল্পকে খাদের কিনারে নিয়ে যাবে।

বাণিজ্য বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে বন্দরের রাজস্ব আয় বাড়বে, কিন্তু একই সঙ্গে ব্যবসায় খরচও বাড়বে। দীর্ঘমেয়াদে এই চাপ দেশের আমদানিরপ্তানি প্রবাহে প্রভাব ফেলতে পারে।

বন্দর সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক আজাদীকে বলেন, ট্যারিফ বাড়ানোর কোনো বিকল্প না থাকায় প্রায় ৪০ বছর পর বিভিন্ন সেবাখাতে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চায় বাংলাদেশ : প্রধান উপদেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধডাকাতির প্রস্তুতি : বন্দর থানায় অস্ত্রসহ দুই যুবক গ্রেপ্তার