চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানি পণ্য জাহাজিকরণ শুরু

কাস্টমসের কার্যক্রম সীমিত পরিসরে শুরু, আজ থেকে পুরোদমে । আমদানি পণ্যের কন্টেনার খালাসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আজ । দুদিনে ৪ হাজার কন্টেনার জাহাজিকরণ হয়নি

হাসান আকবর | সোমবার , ৩০ জুন, ২০২৫ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম কাস্টমসের কার্যক্রম সীমিত পরিসরে শুরু হয়েছে। গত রাত থেকে শুরু হয়েছে রপ্তানিমুখী পণ্য বোঝাই কন্টেনার জাহাজিকরণের কার্যক্রম। তবে আমদানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার খালাসের কাজ শুরুর ব্যাপারে আজ সোমবার সকালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এনবিআরের শাটডাউন কর্মসূচির কারণে মুখ থুবড়ে পড়া দেশের ১৯টি বেসরকারি আইসিডিতেও গতকাল রোববার রাত থেকে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, এনবিআরের ডাকা কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামীকাল (আজ) থেকে পুরোদমে কাজ চলবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দুদিনে আটকা পড়া অন্তত ৪ হাজার টিইইউএস রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার জাহাজিকরণ করে স্বাভাবিক গতি আনতে কয়েকদিন সময় লাগবে। তবে এসব পণ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে। রপ্তানি পণ্যগুলো গত দুদিনে জাহাজিকরণ হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল এসব পণ্য নিয়ে জাহাজ সিঙ্গাপুর বা কলম্বো গিয়ে ইউরোপআমেরিকামুখী মাদার ভ্যাসেল ধরবে। অথচ এনবিআরের শাটডাউনের ফলে পণ্যগুলো মাদার ভ্যাসেল শেষ পর্যন্ত পাবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। মাদার ভ্যাসেল ধরতে না পারলে এসব পণ্য শেষ পর্যন্ত ক্রেতারা নেবেন কিনা তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ব্যবসায়ীশিল্পপতিরা।

গত দুদিন ধরে বিমানবন্দর রোডসহ সন্নিহিত এলাকার সড়কে শত শত পণ্যবাহী গাড়ি অলস সময় কাটাচ্ছিল। গত রাত থেকে সেগুলো ধীরলয়ে নড়াচড়া শুরু করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘিরে দেশের অন্যান্য শুল্ক স্টেশনের মতো চট্টগ্রাম কাস্টমসের সর্বস্তরের কর্মকর্তাকর্মচারীরা অফিসে তালা মেরে কাজ বন্ধ রেখেছিলেন। দিনভর তৎপরতার মধ্যে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।

গত দুদিনে ভ্যাট, ইনকাম ট্যাঙ ছাড়াও শুধুমাত্র চট্টগ্রাম কাস্টমস খাত থেকে সরকার প্রায় ৪শ কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমদানি পণ্য শুল্কায়ন শুরু না হওয়া পর্যন্ত সরকারের রাজস্ব আয়ে গতি আসবে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, এনবিআরকে দুই ভাগ করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব নীতি নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে চালু করার অধ্যাদেশ জারির জের ধরে সরকারের সাথে ভ্যাট ও শুল্কসহ রাজস্ব আহরণকারী বিভাগগুলোর টানাপোড়েন শুরু হয়। জারি করা অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে এনবিআরের আওতাভুক্ত ট্যাঙভ্যাটসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাকর্মচারীরা আন্দোলন শুরু করেন। এতে শুল্ক ও ভ্যাট আদায়সহ সার্বিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে যাওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে অধ্যাদেশ বাস্তবায়নের আগে এনবিআর কর্মকর্তাকর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে আশ্বাস প্রদান করা হয়। সরকারের ওই আশ্বাসের পর সকলে কাজে যোগ দিলেও তারা এনবিআরের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রহমান খানের পদত্যাগের দাবিতে অটল থাকেন। এনবিআর চেয়ারম্যানকে সংস্থায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় এনবিআর চেয়ারম্যান অফিসে কাজে যোগ দেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, এনবিআর চেয়ারম্যান দায়িত্বে এসে আন্দোলনে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা, সেমিনার করার জন্য কক্ষ বরাদ্দ না দেওয়াসহ বেশ কিছু বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এরই জের ধরে সব পক্ষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে রাজস্ব খাতের সংস্কার, এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে গত শনিবার ভোর ৬টা থেকে সারা দেশের ভ্যাট ও শুল্ককরসহ এনবিআরের আওতাধীন সবগুলো কার্যালয়ে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি শুরু করা হয়। এরই জের ধরে সারা দেশে শুল্ককর ও ভ্যাট আদায়ের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে।

গতকাল সরেজমিনে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে গিয়ে দেখা গেছে, গেট বন্ধ। ভিতরে প্রতিটি কক্ষে তালা ঝুলছে। একজন কর্মকর্তাকর্মচারীও কাজে নেই। পুরো কাস্টমস হাউজ খা খা করছে। কয়েকজন কর্মচারী থাকলেও তারা কোনো কাজ করছেন না বা কথা বলছেন না। একজন বললেন, শাটডাউন মানেই সবকিছু বন্ধ। কোনো কাজ হবে না। ইনকাম ট্যাঙ এবং ভ্যাট অফিসের কার্যক্রমও একইভাবে বন্ধ রয়েছে। কোথাও কাজ হচ্ছে না।

শাটডাউন কর্মসূচিতে বেকায়দায় পড়েন আমদানিরপ্তানিকারকরা। তারা প্রয়োজনীয় পণ্য বন্দর থেকে খালাস করতে পারছিলেন না, রপ্তানিকারকরা কোনো পণ্য রপ্তানি করতে পারছিলেন না। আমদানিরপ্তানি কার্যক্রম থমকে যাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর মূলত অচল হয়ে পড়ে। আগে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রাখা জাহাজগুলো থেকে কন্টেনার ইয়ার্ডে নামানো হলেও সেগুলো খালাস করা যাচ্ছিল না। ইতোমধ্যে বন্দরের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠা বেসরকারি আইসিডিগুলোতে কাজ বন্ধ করে দেয় কাস্টমস। ফলে বেসরকারি আইসিডিগুলোতেও কোনো কাজ হচ্ছিল না।

ওই অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা তৈরি হয়। বন্দরের স্ক্যানিং মেশিনে দায়িত্বরত কাস্টমস কর্মকর্তা কাজ না করায় বন্দরে কোনো রপ্তানি পণ্য প্রবেশ করানো সম্ভব হয়নি দুদিন। আমদানি এবং রপ্তানি দুটোই বন্ধ থাকায় বন্দরের সিংহভাগ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ্য, দেশের সমুদ্রবাণিজ্যের আমদানিরপ্তানির অন্তত ৯২ শতাংশ পরিচালিত হয় এই বন্দর দিয়ে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, কাস্টমস আন্দোলন করছে, অথচ ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরকে। দেশের আমদানিরপ্তানি খাতে কোটি কোটি ডলারের ক্ষতির মুখে পড়ে। সময়মতো পণ্য পাঠাতে না পারলে গার্মেন্টস সেক্টরকে বড় মূল্য দিতে হবে। বন্দরের গেট পর্যন্ত পৌঁছেও সময়মতো শিপমেন্ট করতে না পারা দুঃখজনক। এ অবস্থায় গত রাত থেকে রপ্তানি পণ্য জাহাজিকরণ শুরু হওয়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তি দেখা দিয়েছে।

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি এস এম সাইফুল আলম গত রাতে আজাদীকে বলেন, পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছিল। কাজ কিছুটা শুরু হওয়ায় স্বস্তি পাচ্ছি। আজ থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হলে খুশি হবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুদিনে অন্তত ৪ হাজার টিইইউএস কন্টেনার জাহাজিকরণ হয়নি। এসব কন্টেনারের বেশিরভাগই তৈরি পোশাক। এই দুরবস্থা গার্মেন্টস মালিকেরা কীভাবে সামাল দেবেন তা ভাবতেও ভয় লাগছে। কোটি কোটি ডলারের এসব পণ্য যদি ক্রেতারা না নেন তাহলে দেশকেই তার মূল্য দিতে হবে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল আজাদীকে বলেন, এনবিআর ঐক্য পরিষদের ডাকা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির কারণে ব্যবসায়ীরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। নিজেদের স্বার্থে এনবিআর কর্মকর্তারা দেশের প্রায় সব ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে ফেলেছেন। ভবিষ্যতে যেন এই ধরনের কর্মসূচি কেউ পালন করতে না পারে সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে।

আমদানিরপ্তানি ব্যবসার সাথে জড়িত একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, আমাদের পণ্য আটকা পড়ে রয়েছে। শুনলাম আংশিক কাজ শুরু হয়েছে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এভাবে সব বন্ধ করে দেওয়ার সিস্টেমটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ প্রবণতা বন্ধ করা উচিত।

চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম কাস্টমসের একজন কর্মকর্তা বলেন, এটি চট্টগ্রাম কাস্টমসের কোনো ব্যাপার নয়। চট্টগ্রাম কাস্টমস শুধু কেন্দ্রীয় সংগঠনের কর্মসূচিতে একাত্ম হয়েছে। কাস্টমস দৈনিক প্রায় ২শ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপাতত মনে হচ্ছে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। কিন্তু এই রাজস্ব আমরা পাবই। পণ্য ছাড় করানোর আগে ব্যবসায়ীদের এই রাজস্ব পরিশোধ করেই খালাস করতে হবে। তবে রপ্তানিপণ্য বোঝাই কন্টেনার আটকে পড়ায় বিদেশি ক্রেতারা পণ্য না নিলে দেশের রপ্তানিকারকেরা কী করবেন জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, আমরা কাজ করতে প্রস্তুত। সব আয়োজনই আমাদের রয়েছে। তবে কেউ না এলে আমরা কী করব? তিনি জানান, গতকাল বন্দর থেকে কোনো পণ্য ডেলিভারি হয়নি, কোনো রপ্তানি পণ্য ভিতরে ঢোকেনি। তবে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে কাস্টমস এঙপোর্ট কার্গোর কার্যক্রম শুরু করায় পণ্য প্রবেশ শুরু হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএনবিআরের কমপ্লিট শাটডাউন প্রত্যাহার
পরবর্তী নিবন্ধফেরিতে উঠার আগেই পানিতে তলিয়ে গেল বালু বোঝাই ট্রাক