চট্টগ্রাম বন্দরে পরিবর্তনের সুফল

এস এম মনিরুজ্জামান | সোমবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:৫২ পূর্বাহ্ণ

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান কিংবা ছাত্রজনতার আন্দোলনের মধ্যে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয় ৫ আগস্ট। পুরো দেশে তখন অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করে। সব প্রতিষ্ঠান বলতে গেলে অচল হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে সব সিস্টেম। ঠিক সেই মুহূর্তে ১১ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেয় সরকার। এ রকম একটি অস্থির সময়ে দায়িত্ব নিয়েই আমাকে দুটো বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। যা মোকাবিলা করা মোটেই সহজ সাধ্য ছিল না। তা হলো অপারেশন ও বন্দরের নিরাপত্তা। কারণ সে সময় দেশে কার্যত পুলিশ বাহিনী ছিল না। বন্দরে পর্যাপ্ত শ্রমিক ছিলোনা। বন্দর পাহারায় যেসব আনসার ছিল, পরবর্তী সময়ে অন্যান্য আনসারদের সাথে তারাও বিদ্রোহ করেছে। এর মধ্যে বন্দরের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন মহল হুমকি দিচ্ছে। সেসব ম্যানেজ করে বন্দরের অভ্যন্তরে নাশকতা ও চুরি ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। তা না হলে বন্দর লুটপাট হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, গোয়েন্দা সংস্থা, বিজিবিসহ যৌথবাহিনীর সদস্যদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বন্দরের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল বন্দরের অপারেশন সচল রাখা। জুলাইয়ের গণআন্দোলন, ইন্টারনেট সংক্রান্ত সমস্যা এবং বন্যা পরিস্থিতির কারণে বন্দরের অপারেশন বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এ সময় কার্যত কোনো পণ্য পরিবহন হয়নি। তা ছাড়া জাহাজের ওয়েটিং টাইম বেড়ে যায় এবং পণ্য খালাস করতে দেরি হয়। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার কনটেইনার জমা হয়ে যায়। বন্দরের স্বাভাবিক অপারেশন এবং তার সঙ্গে বাড়তি কনটেইনার হ্যান্ডেল করে স্বাভাবিক পর্যায় নিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন মনে হচ্ছিল এই জট ছাড়িয়ে বন্দরের কার্যক্রমের গতি স্বাভাবিক করতে হয়তো বছর পার হয়ে যাবে। কিছু ক্রিয়েটিভ কাজের মাধ্যমে সেই দীর্ঘজট ছাড়িয়ে মাত্র দুইতিন মাসের মধ্যে বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে নিয়ে আসতে পারাটা বড় রকমের অর্জন। এই অর্জনের পেছনে এনবিআর, জেলা প্রশাসন, রেলওয়ে আর বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের সকল স্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী, শ্রমিকসহ সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সম্মিলিত শক্তিটা কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে বলেই অল্প সময়ে সফলতা এসেছে।

অপারেশনাল কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করি। আগে জাহাজ বন্দরে আসতে প্রায় আট দিন অপেক্ষা করতে হতো। এখন সরাসরি চলে আসে। বিদেশ থেকে আসা জাহাজকে এখন আর আগের মত বহিঃনোঙরে অপেক্ষা করতে হয় না। কিছু জাহাজের নিজস্ব ক্রেন আছে, যাকে গিয়ার্ড ভেসেল বলে। কিছু জাহাজের নিজস্ব ক্রেন নেই। আমাদের এনসিটিতে সাধারণত ক্রেনবিহীন জাহাজগুলো আনি। জিসিবিতে ক্রেনযুক্ত গিয়ার্ড জাহাজ অথবা বন্দরের ক্রেন ব্যবহার করে এ ধরনের জাহাজ আনা হয়। অন্যদিকে গিয়ারলেস ভেসেল CCT/NCTতে আনা হয়। এখন আমরা গিয়ারলেস এবং গিয়ারড ভেসেল সমন্বয় করি, যাতে শতভাগ জেটি বা বার্থ ব্যবহার করতে পারি এবং যে কোনো জাহাজ এলে সহজে ভিড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, আগে তুলনামূলকভাবে ছোট জাহাজ আসত। একটা জাহাজে ৮০০১২০০ কনটেইনার বহন করত। এখন আমরা আমদানীকারকগণকে ম্যাক্সিমাম ক্যাপাসিটির জাহাজ আনতে উদ্বুদ্ধ করি। যেটাকে সিসি অ্যাগ্রিমেন্ট বলে। ফলে বড় জাহাজে অনেক বেশি কার্গো আসে। দেখা যাচ্ছে প্রায় ২৫০০ কনটেইনার একবারে নিয়ে আসতে পারে। এজন্য জাহাজের সংখ্যা কমছে, ক্যাপাসিটি বেড়েছে। খরচ কমেছে, ব্যবস্থাপনায় পেয়েছে গতি। তাছাড়া বন্দরের ভেতরের জায়গা অকুপায়েড ছিল। অনেক ক্ষেত্রে ডিসিপ্লিন ছিল না। ট্রাফিক ডিসিপ্লিন, কনটেইনারের ম্যানেজমেন্ট এগুলো ছিল না বললেই চলে। আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমরা প্রায় শতভাগ শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছি। ভেতরে অনেক কনটেইনার দীর্ঘদিন যাবৎ পড়ে ছিল, সেগুলো অপসারণ করা হয়েছে। চারটি ট্যাংকারে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল দাহ্য পদার্থ আইনি জটিলতায় দীর্ঘদিন পড়ে ছিল, যেগুলো যে কোনো সময় বিস্ফোরণ হতে পারত। এটা দ্রুততম সময়ে সরিয়ে ফেলি। অল্প সময়ে এটা অকশনের ব্যবস্থা করি, ফলে সরকার রাজস্ব পেয়েছে। আইটেমসমূহ ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার হয়েছে। আরও বেশকিছু ডেনজারাস কার্গো ছিল, যা আমরা ক্লিয়ার করে ফেলেছি। অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণগুলো স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি টেস্ট করছে। এগুলো ব্যবহার করা না গেলে অল্প সময়ের মধ্যে ধ্বংস করার ব্যবস্থা করব। বন্দর এখন বিপজ্জনক কার্গো থেকে ঝুঁকিমুক্ত। ১২০টি রিফার কনটেইনার (শিপিং কনটেইনার) প্রায় ৯ মাস ধরে প্লাগিন ছিল। এগুলোর মাধ্যমে মাংস এবং ফলমূল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন পড়ে থাকার ফলে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এগুলো ডিসপোজ করা কঠিন ছিল। পাশাপাশি পরিবেশের ছাড়পত্রের ব্যাপার ছিল। জেলা প্রশাসনের সহায়তায় সেগুলো ডিসপোজ করি। এজন্য বিদেশে মেইন লাইন অপারেটররা আমাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এ ধরনের কাজ বিগত ১০১৫ বছরে হয়নি। সেটা ৩৪ মাসের মধ্যে করতে পেরেছি। অত্যন্ত আনন্দের বিষয়, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত হয়েছে।

কনটেইনার অপসারণের ফলে বন্দরের ভেতরে জায়গা বেড়েছে। আগে জায়গায় সংকুলান হতো না। তাই এফিসিয়েন্সি অনেক কমে যেত। এখন সমন্বয়ের ফলে শৃঙ্খলা ফিরেছে, হ্যান্ডলিং ফাস্ট হয়েছে। তারপর গুরুত্ব দিয়েছি টেকনোলজির ওপর। আমরা বন্দরের কার্যক্রম নিয়ে ফুল অটোমেশনে যাব, যেটা আমরা বলছি মেরিটাইম পোর্ট সিঙ্গেল উইন্ডো করছি। এগুলো করার ফলে কাস্টমসে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং আগে যেখানে লাগত ছয়সাত দিন এখন তা তিনচার দিনে হয়ে যাচ্ছে। কনটেইনার হ্যান্ডেলিং স্পিড এসেছে। জেনারেল কার্গোর অতীতের রেকর্ড ভাঙতে সক্ষম হয়েছি। প্রায় ১২৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন জেনারেল কার্গো হ্যান্ডেলিং করেছি।

তাছাড়া গত সরকারের আমলে বন্দর নানা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ছিল। সিন্ডিকেট ভাঙার উদ্যোগ নিয়েও আমরা সফল হয়েছি যার ফলে বন্দরে ২৫ শতাংশ খরচ কমেছে। সিন্ডিকেট ভাঙতে গিয়ে বিভিন্নভাবে ইন্টারফেয়ারেন্স এসেছে। এগুলো কেয়ার করিনি। প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয়ে নীতিমালা করে পেপার সার্কুলার দেব। যারা কোয়ালিফাই করবে তাদের মোস্ট ওয়েলকাম। কারণ পোর্ট সবার। এটা কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। পোর্টকে আমি জনবান্ধব করতে চাই। মানুষ যেন পোর্টকে ব্যবহার করতে পারে, এর সুফল পায়। এজন্য কাজ করতে হবে স্বচ্ছতা, ন্যায় ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে। এটা শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পারলেই জনগণ ভালো থাকবে।

তাই রাষ্ট্র এবং মানুষের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যেটা ভালো হবে তা করার চেষ্টা করব। কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করব না। এটা আমার প্রতিজ্ঞা।

লেখক : চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ২০২৫ সালের মার্কেটিং ল্যান্ডস্কেপ
পরবর্তী নিবন্ধপদুয়ায় সন্ত্রাস বিরোধী বিক্ষোভ ও মানববন্ধন