চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা

কমপ্লিট শাটডাউন । কাজ বন্ধ রেখেছেন কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা । পণ্যে শুল্কায়ন, বিল অব এন্ট্রি দাখিলসহ অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ

হাসান আকবর | রবিবার , ২৯ জুন, ২০২৫ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘিরে চট্টগ্রাম কাস্টমসের সর্বস্তরের কর্মকর্তাকর্মচারীরা কাজ বন্ধ রেখেছেন। এতে করে চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। আজকের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কাস্টমসের বন্ডেড ওয়্যার হাউজ খ্যাত চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক কার্যক্রম শুল্কায়ন প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল। শুল্কায়ন কার্যক্রম বন্ধ হলে স্বাভাবিকভাবে বন্দরে তার ধাক্কা লাগে। কাস্টমস কর্মকর্তারা কাজ বন্ধ করে দেওয়ার জের ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার ও পণ্যজটের পাশাপাশি জাহাজজটও প্রকট হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আন্দোলন শুরু হয় গত মাসে। এনবিআরকে দুই ভাগ করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব নীতি নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। সেটি বাতিলের দাবিতে কলম বিরতিসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে নামেন এনবিআরের আওতাভুক্ত ট্যাক্স ভ্যাটসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাকর্মচারীরা। পরে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, অধ্যাদেশ বাস্তবায়নের আগে এনবিআরের কর্মকর্তাকর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। সরকারের আশ্বাসের পর কাজে যোগ দিলেও আন্দোলনকারীরা এনবিআর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রহমান খানকে পদত্যাগের দাবিতে অটল থাকেন এবং সংস্থার কার্যালয়ে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। পরে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তায় অফিসে ফেরেন এনবিআর চেয়ারম্যান।

আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এনবিআর চেয়ারম্যান দায়িত্বে এসে আন্দোলনে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা এবং সেমিনার করার জন্য কক্ষ বরাদ্দ না দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষুব্ধ হন আন্দোলনকারী কর্মকর্তারা। এরই জের ধরে সব পক্ষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে রাজস্ব খাতের সংস্কার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে গতকাল থেকে সারা দেশের শুল্ককর কার্যালয়ে লাগাতার শাটডাউন কর্মসূচি শুরু করা হয়। আর এই কর্মসূচির সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগে চট্টগ্রাম বন্দরে। এনবিআরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ চট্টগ্রাম কাস্টমসও কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি শুরু করলে চট্টগ্রাম বন্দরে বড় ধাক্কাটি লাগে। দেশের সমুদ্র বাণিজ্যের আমদানিরপ্তানির অন্তত ৯২ শতাংশ পরিচালিত হয় এই বন্দর দিয়ে। কাস্টমসে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পণ্যের শুল্কায়ন, বিল অব এন্ট্রি দাখিলসহ অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে বন্দরে আসা পণ্যের সরবরাহ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অচলাবস্থা শুরু হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। গতকাল শনিবার সকাল ৬টা থেকে এই কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর বন্দর থেকে পণ্য খালাস কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে। আমদানিরপ্তানি পণ্যের শুল্কায়নও বন্ধ হয়ে গেছে।

বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, আমাদের কার্যক্রম এখনো চলছে। তবে কাস্টমসের কার্যক্রম শুরু না হলে আমাদের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যাবে। তারা বলেন, শুল্কায়ন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আগে যেসব জাহাজের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রাখা হয়েছিল সেগুলো জেটিতে পণ্য ওঠানামা করাচ্ছে। যেসব পণ্যের শুল্ক আগে পরিশোধ করা ছিল সেগুলোও খালাস হচ্ছে। তবে গতকাল সকাল থেকে কোনো জাহাজেরই নিবন্ধন হয়নি। এসব জাহাজ বহির্নোঙরে এসে অবস্থান করলেও কর্মসূচি প্রত্যাহার বা কাস্টমস কাজে যোগ না দেওয়া পর্যন্ত জেটিতে ভিড়তে পারবে না। কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে দুয়েকদিনের মধ্যেই পুরো বন্দর অচল হয়ে যাবে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

তারা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর হচ্ছে কাস্টমসের ওয়্যার হাউজ। বন্দর নিজে কোনো পণ্য গ্রহণ, জাহাজিকরণ কিংবা খালাস করতে পারে না। কাস্টমসের নানা প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় বন্দর শুধু পণ্য গ্রহণ এবং জমা করে রাখে। কাস্টমস প্রক্রিয়া শেষে জাহাজ থেকে পণ্য নামে, আমদানি পণ্য খালাস বা ডেলিভারি হয়। একইভাবে রপ্তানি পণ্য জাহাজিকরণ করা হয়। এখন কাস্টমস যদি সব কাজ বন্ধ করে রাখে তাহলে বন্দরের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যের কোনো পণ্যই হ্যান্ডলিং করতে পারবে না।

শিপিং বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কাস্টমসের অচলাবস্থার জের ধরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস বন্ধ হয়ে গেলে জট তৈরি হবে। কন্টেনারজটের পাশাপাশি পণ্যজটও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। অপরদিকে বহির্নোঙরে অবস্থানকারী জাহাজের সংখ্যা বেড়ে যাবে। কাস্টমস প্রক্রিয়া শেষ না করা কোনো জাহাজই জেটিতে আসতে পারবে না। এতে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করবে।

একাধিক আমদানিকারক গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, এনবিআরের কর্মকর্তাকর্মচারীরা কিছুদিন আগেও কলম বিরতি কর্মসূচি পালন করেছেন, কাজ করেননি। ওই সময় বন্দরে বড় আকারের কন্টেনারজট তৈরি হয়। আগের ধকল সামলে ওঠার আগেই নতুন করে শাটডাউনের মতো কর্মসূচি দেশের আমদানিরপ্তানি কার্যক্রমকে বড় ধরনের সংকটে ফেলল।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এক বিবৃতিতে বলেছে, কাস্টমসে কলম বিরতির কারণে কন্টেনার ছাড় বিলম্ব, বন্দরে জট ও বন্দরের ৪ গুণ কন্টেনার রেন্ট বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। শিল্প কারখানা ও ব্যবসাবাণিজ্য ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে উল্লেখ করে মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহসভাপতি এ এম মাহবুব চৌধুরী সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যেকোনো দেশের উন্নয়ন সম্পূর্ণ নির্ভর করে সে দেশের শিল্পবাণিজ্য সম্প্রসারণ, রপ্তানি ও তার গতিশীলতার ওপর। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠান দেশের শিল্পবাণিজ্য রক্ষার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে নিজেদের একতরফা কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে। দেশের রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রায় গত দেড় মাস ধরে যেভাবে কলম বিরতি, কমপ্লিট শাটডাউন ইত্যাদি নামে প্রাতিষ্ঠানিক হরতালে লিপ্ত হয়েছে তাতে দেশে আমদানিরপ্তানি, রাজস্ব আহরণ সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়েছে।

বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, আমদানিরপ্তানি কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনারজট সৃষ্টি হচ্ছে। বন্দর কন্টেনার রেন্ট স্বাভাবিক হার থেকে ৪ গুণ বেশি আদায় করছে; যা দেশের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালেন তারেক রহমান
পরবর্তী নিবন্ধটেকনাফে পানিবন্দি চার শতাধিক পরিবার