অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজ জন্ম শহরে এসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন এবং নির্দেশনা দান করেছেন। তিনি বলেছেন, বিশাল অর্থনীতি হবে যদি বন্দরকে বিশাল হৃৎপিণ্ড করতে পারি। চট্টগ্রাম সওদাগরদের শহর উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, নৌকা নিয়ে, পালতোলা জাহাজ নিয়ে কে কোথায় চলে যাবে। এখানে ভিড়েছে। আরবরা এসেছিল, পর্তুগিজরা এসেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে চাটগাঁর লোকই সওদাগরের বৃত্তি বেছে নিয়েছে। তারা ব্যবসা চেনে। চাকরির কথা বললে, বলে চাকরি কেন করবে বোঝে না। আমাদের মা বাবারা দোকানে বসাই দেন। আমিও দোকানে বসেছি। তারা চিন্তা করে না চাকরি বলে একটা জিনিস আছে। দেশ বিদেশে যাবে ব্যবসা করবে। আমাদের রক্ত হলো সওদাগরের রক্ত। চট্টগ্রাম হলো এ সওদাগরের পীঠভূমি। এদের ছেড়ে দিলে, এদের হাতে ছেড়ে দিলে দেখবে শুধু বাংলাদেশ না সারা দুনিয়াতে করে দেখাবে। যদি তারা এত দুনিয়াতে ছড়িয়ে যায় আজকে বন্দর ব্যবস্থাপনায় যারা যুক্ত হবে বাংলাদেশে চিন্তা করেন তারা কোথায় কোথায় যাবে। দুনিয়ার কোনো বন্দর রাখবে না যেখানে বাংলাদেশি নেই। টপ ক্লাস সার্ভিস তারা দেবে। সেটাই আমাদের ভবিষ্যৎ। যেটা আমাদের রক্তের ভেতরে আছে, ঐতিহ্যের ভেতরে আছে। আমরা যেন এটাকে অবহেলা না করি। দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। আমাদের বিশাল অর্থনীতি হবে যদি চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশাল হৃৎপিণ্ডে পরিণত করতে পারি। বন্দর ফ্যাসিলিটি দিলে বিস্তীর্ণ এলাকা দিলে যেকোনো ব্যবসায়ী এসে এখানে বিনিয়োগ করবে। তাকে অনুরোধ করে আনতে হবে না। তার নিজের টানে আসবে। আমরা ডিজিটালাইজেশনের কথা বলেছি। সব কিছু দরকার। তার আগে আমাদের স্বপ্নটা দরকার। যেটা আমরা করবোই। এর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুতবেগে পরিবর্তন হতে শুরু করবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, স্ক্রিনে দেখছি চট্টগ্রাম বন্দরের পরিস্থিতি। আমাদের মতো দেশে, একটা বন্দর, কয়েকটা টার্মিনাল নিয়ে কথা বলছি। অনেক দেশের এ রকম ২০–৩০টা বন্দর, টার্মিনাল ভরে আছে বিশ্বমাপের, বিশ্ব সাইজের। সেদিকে তাকালে আমাদের খুব ক্ষীণ মনে হয়। এ বন্দর দিয়ে তো রোগী বেশি দিন টিকবে না। টেকানো যাবে না। কাজেই এটাকে শক্তিশালী করতে হবে। ক্রমাগতভাবে এটাকে শক্তিশালী করতে হবে। একবার শক্তিশালী করে দিলেই হবে না। সেটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ।
এ কথা সত্যি যে, ঐতিহ্যগতভাবে চট্টগ্রাম ভূ–প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর নগরী। এই নগরীকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার অনেক অবারিত সম্ভাবনা রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির ৮০ শতাংশের বেশি আয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে অর্জিত হয়। এ কারণেই চট্টগ্রামকে বলা হয় জাতীয় অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। আমদানি–রফতানির ক্ষেত্রেও ৮০ শতাংশ কার্যক্রম পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম থেকেই। এই চট্টগ্রাম থেকে সরকার যে ট্যাঙ নিয়ে যাচ্ছে। তাই চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রগতি জরুরি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দর। সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরকে বলা হয় বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার। প্রতিবছর এর উৎপাদন প্রবৃদ্ধি এবং রাজস্ব প্রবৃদ্ধি দেশের বার্ষিক জিডিপিকে সমৃদ্ধ করে থাকে। এ বন্দর আজ দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা। দক্ষিণ এশিয়ায় সমমানের বন্দর সমূহের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতনভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি নিতান্তই অপ্রতুল। বন্দর কর্মীদের মজুরী আন্তর্জাতিক মানের হওয়া উচিৎ ছিলো। সার্বক্ষণিক ঝুঁকি নিয়ে তাদের কর্মস্থলে নিয়োজিত থাকতে হয় কিন্তু নেই কোন ঝুঁকিভাতা। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে, নতুন ধরনের পণ্য খালাসের সুবিধা প্রদান করতে আর পণ্য ওঠানামার সময় কমিয়ে সেবার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে তিলে তিলে নতুন মাত্রায় গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বন্দর। আজকের বন্দর বিগত দিনের চেয়ে আরও বেশি কর্মক্ষম এবং আগামীর বন্দর হতে যাচ্ছে আরও আকর্ষণীয়, আরও সমৃদ্ধ এবং আরও বেশি কার্যকর। কনটেইনার ওঠানামায় নতুন রেকর্ড গড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। ২০১৮ সালে যেখানে কনটেইনার ওঠানামা হয়েছিল ২৯ লাখ ৩ হাজার টিইইউস, ২০১৯ সালে সেটি হয়েছে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার টিইইউস। প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৬.৩৪ শতাংশ। আর সাধারণ কার্গো ওঠানামা হয়েছে ১০ কোটি ৩০ লাখ মে. টন। এই খাতে প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৭.০৩ শতাংশ। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের এই পরিসংখ্যান চট্টগ্রাম বন্দরের ৩০ বছরমেয়াদি প্রক্ষাপণকে ছাড়িয়ে গেছে। ক্রমবর্ধমান কনটেইনার পরিবহনের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন শুরু করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ যার প্রত্যক্ষ ফলাফল এই পরিসংখ্যান। যেহেতু চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বও এরসঙ্গে জড়িত। তাই বন্দর নিয়ে এবং বন্দরের সমৃদ্ধি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। একে শক্তিশালী করতে হবে। তবে তা যেন ভেবেচিন্তে দেশের স্বার্থে করি।