চট্টগ্রাম বন্দরকে যে কোনো উপায়ে সচল রাখতে হবে

| শুক্রবার , ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

ঐতিহাসিকভাবেই বিশ্বের প্রসিদ্ধতম বন্দরগুলোর একটি চট্টগ্রাম। বন্দর হিসেবে চট্টগ্রাম বহু প্রাচীন। সম্ভবত খ্রিস্ট-পূর্ব ৪০০ বছর আগেও চট্টগ্রামকে সমুদ্রযাত্রার জন্য বন্দর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, নবম শতকে আরব বণিকরা এ উপমহাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে চট্টগ্রাম বন্দরকে নিয়মিতভাবে ব্যবহার করেছেন। মার্কো পোলো ও ইবনে বতুতা দুজনই বিশ্ব পরিভ্রমণের পথে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিলেন। ষোড়শ শতকের প্রারম্ভে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে আসন পেতে বসে। তারা চট্টগ্রামকে বলত পোর্টো গ্রান্ডো বা বড় বন্দর আর হুগলীকে বলত পোর্টো পিকুইনো বা ছোট বন্দর। চট্টগ্রাম পর্তুগিজদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে তাদের প্রসিদ্ধ মহাকাব্য লুসিয়াদ-এ, যে মহাকাব্যের প্রধান নায়ক ভাস্কো দা গামা, সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের উল্লেখ রয়েছে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে চট্টগ্রামেই তৈরি হতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জন্য বৃহৎ সব রণতরী ও নৌযান।
সেই বন্দর যখন নানা সময়ে অচল থাকে, কিংবা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়, তখন তার ক্ষতির ভার সবাইকে বহন করতে হয়। ধর্মঘটে চট্টগ্রাম বন্দর অচল হয়ে পড়লে যে প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে গিয়ে পড়ে, তার হিসেব মেলানো দুষ্কর।
আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, চট্টগ্রাম বন্দর স্থানীয় কোনো ইস্যু নয়। এটি জাতীয় বিষয়। চট্টগ্রাম বন্দর পিছিয়ে পড়লে দেশের অথর্নীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশ পিছিয়ে যাবে। আমরা দেখছি, বর্তমানে দেশে প্রতিনিয়ত ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। সে ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর ততোটা প্রস্তুত কিনা ভাববার বিষয়। যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এগিয়ে যাচ্ছে, সেভাবে এগিয়ে নেওয়া বা প্রস্তুত করা, সক্ষমতা বাড়ানো হলো আসল কথা।
বন্দরের অগ্রগতি বিষয়ে অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মু. সিকান্দর খান এক সময় বলেছিলেন, চট্টগ্রাম বন্দর পিছিয়ে পড়ার দুটি তত্ত্ব রয়েছে বলে মনে করি। একটি হচ্ছে অদক্ষতা তত্ত্ব, আরেকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। অদক্ষতা তত্ত্ব হচ্ছে সমস্যাগুলো জিইয়ে রেখে চট্টগ্রামকে দাবিয়ে রাখা। এ জন্য সর্বোচ্চ সুফল পেতে হলে যোগ্য ব্যক্তিদের যোগ্য জায়গায় নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হচ্ছে চট্টগ্রামকে এড়িয়ে দেশের অন্য এলাকায় কম সুবিধাজনক স্থানে বন্দর গড়ে তোলার চেষ্টা। চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা বাড়াতে যত খরচ হবে, অন্য জায়গায় এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি খরচ হবে এমন প্রকল্পও নেওয়া হচ্ছে। বন্দরের জায়গা কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে বরাদ্দের বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। ভবিষ্যতে বন্দরের সমপ্রসারণের জন্য জায়গা থাকছে কি না দেখতে হবে। কাউকে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হলে বন্দর ব্যবহারকারীদের কাছে কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা করা উচিত।
বন্দরে যেসব সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো সমাধানের জন্য শুধু শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। যে যে অবস্থানে আছে, সেই অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলেন, এই বন্দরে জাহাজ চলাচল নির্ভর করে জোয়ার-ভাটার ওপর। জোয়ারের সময় সাগর থেকে জেটিতে জাহাজ আসা-যাওয়া করে। সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দরে ২৪ ঘণ্টা জাহাজ চলাচল করে। সাগর থেকে বন্দর জেটিতে জাহাজ আনা-নেওয়ার সময় তিনটি বাঁক রয়েছে, যে কারণে বড় আকারের জাহাজ জেটিতে আনা যায় না। অবকাঠামোগত সমস্যাও আছে। বন্দরের পুরোনো তিনটি জেটি ভেঙে কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। আবার নিউমুরিং টার্মিনাল নির্মাণ হলেও ২০০৭ সালের পর থেকে গ্যান্ট্রি ক্রেন যুক্ত হয়নি। এটাও বড় ব্যর্থতা। এই গ্যান্ট্রি ক্রেন ও কেসিটি টার্মিনাল নির্মাণ হলে বন্দরে এত সমস্যা হতো না। জেটি ও যন্ত্রপাতির পাশাপাশি বন্দরের ডক লেবার কলোনি এলাকায় কনটেইনার রাখার জন্য ‘ওভার ফ্লো ইয়ার্ড’ নির্মাণে বন্দর কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করেছে। এটি আরও আগে নির্মাণ শুরু করা উচিত ছিল।
বন্দর থেকে এখন নদীপথে কনটেইনার পরিবহন হচ্ছে। কনটেইনার পরিবহনে রেলেরও সক্ষমতা বাড়ানো উচিত। বন্দরের পর্ষদকে অবকাঠামো উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকা এবং যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ৫০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হোক। আর্থিক ক্ষমতা বাড়লে কেনাকাটার জন্য ফাইল চালাচালি করতে হবে না। বন্দরের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন কার্যক্রম হাতে নেওয়া থেকে বন্দরের বিরত থাকা উচিত। বন্দরের উচিত হবে, পণ্য পরিবহনের সুবিধা বাড়ানোর কাজে অগ্রাধিকার দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পোর্ট কাউন্সিল গঠন করা যায় কি না, ভেবে দেখা দরকার।
বর্তমান সরকার চট্টগ্রামের উন্নয়নে যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তার সবই বাস্তবায়ন হবে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে। এসবের মাধ্যমে চট্টগ্রামের উন্নয়ন যেমন ত্বরান্বিত হবে, তেমনি ত্বরান্বিত হবে দেশের উন্নয়ন। আমরা মনে করি, বন্দরের উন্নয়নের ওপর দেশের উন্নয়ন নির্ভর করছে। তাই চট্টগ্রাম বন্দরকে যে কোনো উপায়ে সচল রাখতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে