চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ : স্পেশাল নয়, চাই স্থায়ী ট্রেন

ইয়াসির সিলমী | শনিবার , ১৫ জুন, ২০২৪ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

১৮৫৩ সালে বাণিজ্যিকভাবে প্রথমবারের মত রেল চলাচল শুরুর মধ্যদিয়ে উপমহাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মুম্বাই থেকে বিস্তৃত হয়ে এ রেল নেটওয়ার্ক ক্রমান্বয়ে গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। যা সর্বশেষ পূর্ববঙ্গের দোহাজারীতে এসে থামে। ১৮৯০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এ রেলপথকে দোহাজারী থেকে বার্মার (মিয়ানমার) ঘুনধুম পর্যন্ত সমপ্রসারণের উদ্যোগ নেয়। তবে বিশ্বযুদ্ধসহ নানা জটিলতায় সে উদ্যোগ আর বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে চট্টগ্রামকক্সবাজার অঞ্চলের ৫ প্রজন্ম ১৩৪ বছর ধরে নতুন রেলপথের জন্য অপেক্ষা করেছে। আর দোহাজারী ‘আখেরী রেল স্টেশন’ তকমায় পাড়ি দিতে পারেনি সাঙ্গু নদী।

অবশেষে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ রেলপথ গত বছরের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনকালে তিনি বলেছিলেন, নতুন এই রেলপথ পর্যটন, শিল্পায়ন, ব্যবসা ও বাণিজ্য বাড়ানোর সাথে সাথে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড় করানোর নতুন আশার সঞ্চার করেছে। উদ্বোধনের পর থেকে ঢাকাকক্সবাজার রুটে গত ডিসেম্বরে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ ও জানুয়ারি থেকে ‘পর্যটন এক্সপ্রেস’ নামে দুটি ট্রেন যাত্রী পরিবহন শুরু করে। তবে চট্টগ্রামকক্সবাজার রুটে স্থানীয়দের জন্য কোন সার্ভিস ছিল না।

তাদের দাবির প্রেক্ষিতে গত ৮ এপ্রিল ঈদুল ফিতর উপলক্ষে চট্টগ্রামকক্সবাজার রুটে একটি স্পেশাল ট্রেন চালু করে রেলওয়ে। ট্রেনটি ঈদ স্পেশাল হলেও যাত্রীদের ব্যাপক সাড়ায় দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ১০ জুন পর্যন্ত করা হয়। যেখানে বাসে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে লাগে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা, সেখানে প্রায় অর্ধেক ভাড়ায় সাড়ে ৩ ঘণ্টায় রেলেই পৌঁছানো যাচ্ছিল। তাছাড়া আরামদায়ক ও নিরাপদ হওয়ায় দ্রুতই জনপ্রিয়তা পায় এ সার্ভিস। বন্ধ হওয়ার আগে মাত্র ৫২ দিনে এই ট্রেন ৫৪ হাজার ৮১৪ জন যাত্রী পরিবহন করে ১ কোটি ৪ লাখ ৪১ হাজার টাকা আয় করে। দৈনিক আয় দুই লক্ষ টাকা। যা ২৫ বছর ধরে লোকসানে থাকা রেলওয়ের জন্য সম্ভাবনারই বার্তা। স্পেশাল সার্ভিসটিকে ১০ থেকে ১৮ বগিতে উন্নীত করে স্থায়ী রূপ দিয়ে দিনে দুই ট্রিপ চালানোর উদ্যোগ নেয় রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল। এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব রেলওয়ে সদর দফতরে পাঠানো হয়। কিন্তু এরপর ঘটলো উল্টো ঘটনা।

১৩৪ বছর অপেক্ষায় শুরু হওয়া চট্টগ্রামকক্সবাজারবাসীর এ আনন্দযাত্রা স্থায়ী হয়নি ১৩৪ দিনও। ইঞ্জিন ও লোকবল সংকটের অজুহাতে গত ৩০ মে বন্ধ হয়ে যায় স্পেশাল সার্ভিসটি। অথচ প্রত্যাশা ছিল সিংগেল থেকে ডাবল ট্রিপে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার যাত্রী পরিবহনের। ৫ প্রজন্মের অপেক্ষা আর ১ হাজার ৩৯১ একর জমি ছেড়ে দেওয়া স্থানীয়দের প্রতি কি রেলের কোন দায় নেই? ১০১ কিলোমিটার রেলপথের ১৫ কিলোমিটার বনভূমিতে পড়ার পরিবেশ বিপর্যয়ও সামলাতে হবে স্থানীয়দের। এমনকি গতবছর বড় ধরনের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুই জেলার কয়েক লক্ষ মানুষ। সে সময় রেললাইনের কারণে বৃষ্টির পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়াকে বন্যার কারণ বলে দাবি করেছিল তারা।

এ প্রকল্প উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ‘আমি রেলপথ উদ্বোধন করে আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। এটা এ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। আজ সেই দাবি পূরণ হয়েছে।’ এখন প্রশ্ন হল সরকার প্রধান যে প্রতিশ্রুতি রক্ষার ঘোষণা দিয়েছিলেন তা রেলওয়ের বাস্তবায়ন করছে না কেন? অথচ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বা অনুশাসন রক্ষা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দায়িত্ব। সেখানে মৌসুমি পর্যটকদের জন্য স্থায়ী ট্রেন, আর স্থায়ী মানুষদের জন্য মৌসুমি ট্রেনের এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্তে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। যার প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বত্র। দেশের আর কোন রুটে স্থানীয়দের প্রতি এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়নি। রেলের শিডিউল বলছে, চট্টগ্রাম থেকে ফেনি, কুমিল্লা, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ অনেক রুটে একাধিক ট্রেন আছে। যেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে সেসব অঞ্চলের বাসিন্দারা।

প্রায় ১৫ হাজার কোটির দোহাজারীকক্সবাজার রেলপথের পরিপূর্ণ ব্যবহার দৃশ্যমান হওয়ার আগে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার বরাদ্দ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। সবমিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি বিনিয়োগের রেলপথে শুধুমাত্র একজোড়া ট্রেন চালানোটা অতি বিলাসিতা ছাড়া আর কী হতে পারে? এত বড় প্রকল্প ঘিরে পর্যাপ্ত লোকবল ও ইঞ্জিন না থাকার বিষয়টিকে আপাতদৃষ্টিতে রেলওয়ের দুরদর্শিতার অভাব নাকি উদাসীনতা সেটিও খতিয়ে দেখা উচিত। যে ইঞ্জিন সংকটের ঠুনকো অজুহাতে চট্টগ্রামকক্সবাজার ট্রেন বন্ধ করা হল তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে (আজকের পত্রিকা) ৩ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ও দিনাজপুরের পার্বতীপুর লোকোশেডে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা মূল্যের ১৫ টি ইঞ্জিন পড়ে আছে। এই ইঞ্জিনগুলো সংস্কার করে অনায়াসে এ রুটসহ অন্যান্য রুটের সংকট কিছুটা হলেও মেটানো যাবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এই সংকট কি তবে কৃত্রিম?

চট্টগ্রামকক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন বন্ধের প্রতিবাদ জানিয়েছে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি নামক একটি সংগঠন। গত ১ জুন দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সংগঠনটি স্থানীয় জনগণের সুবিধার্থে এ রুটে দুই জোড়া নতুন ট্রেন চালুর দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে গত ৩০ মে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি দাবি করেছে, বাস মালিকদের সুবিধা দিতেই তাদের ‘প্রেসক্রিপশনে’ হঠাৎ চট্টগ্রামকক্সবাজার স্পেশাল সার্ভিস বন্ধ করা হয়েছে। যদিও তাদের এ দাবির পক্ষে কোন তথ্যপ্রমাণ নাই। তবে স্পেশাল ট্রেন দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ার প্রেক্ষিতে এই রুটের অনেকগুলো বাস কোম্পানি তাদের ভাড়া উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেয়ায় সহজেই অনুমেয় ট্রেনের জনপ্রিয়তা বাস মালিকদের কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলেছে। আর যাত্রী পরিসংখ্যান বলছে, রেললাইনে যাতায়াত বাড়লেও তা সড়কপথে বড় প্রভাব রাখতে পারবে না। কেননা চট্টগ্রামকক্সবাজার রুটে দৈনিক যাত্রী চাহিদার তুলনায় রেলের সক্ষমতা অনেক কম। সুতরাং কোন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখানে টিকবে না। তাই সমস্যাটা রেলের অভ্যন্তরে কি না সেটিই বরং আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত। এত বড় প্রকল্প কয়েক শত কোটি টাকার ইঞ্জিন কিংবা কয়েকজন লোকো মাস্টারের অভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ রেলসেবা বঞ্চিত হতে পারে না।

এদিকে স্পেশাল ট্রেন বন্ধে জনসাধারণের ক্ষোভের আগুনে আপাতত জল ঢেলে গত বুধবার (১২ জুন) থেকে ঈদুল আজহা উপলক্ষে স্পেশাল সার্ভিসটি সপ্তাহ দুয়েকের জন্য আবারও চালু করেছে রেলওয়ে। তারমানে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারবাসী সহসা এ মেগা প্রকল্পের স্থায়ী সুফল পাচ্ছে না। এ অঞ্চলের মানুষের দাবি রেলভবনে যে সহসা পৌঁছায় না তা চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যাত সিআরবিতে বাণিজ্যিক হাসপাতাল বিরোধী আন্দোলনের সময়ই বুঝা গেছে। শেষমেশ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে হাসপাতাল স্থাপনের পরিবেশবিরোধী এ প্রকল্প বাদ দেয়া হয়। এবারও কি তবে প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করে রেলকর্তাদের বোঝাতে হবে স্থানীয়দের রেলের প্রয়োজন কতটা? এ অঞ্চলের ১০জন সাংসদ ও ২জন প্রতিমন্ত্রী অবশ্য নিজেদের জায়গা থেকে রেলওয়ে কিংবা সরকারের উচ্চ মহলে কথা বলে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সব সংকট নিরসন হোক, চট্টগ্রামকক্সবাজার রুটে স্থানীয়দের জন্য স্থায়ী ট্রেন সার্ভিস চালু করা হোক। পাশাপাশি এ অঞ্চলের সাথে পর্যটন ও বাণিজ্যের প্রসারে সিলেট, উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের অন্যান্য এলাকার সাথে যাত্রী ও কার্গো সার্ভিস চালু করা জরুরি। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ কালুরঘাট সেতুর বদলে নতুন রেলসেতু নির্মাণ, ক্রমবর্ধমান যাত্রী চাহিদা এবং চীনের সাথে ভবিষ্যতে রেল যোগাযোগ স্থাপনের সম্ভাবনা বিবেচনায় চট্টগ্রামকক্সবাজার রেলপথকে ডাবল লাইনে উন্নীত করার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

সবশেষে বলতে চাই, ১৩৪ বছরের অপেক্ষা যে জনপদের, সেখানকার যাত্রীসাধারণকে রেলওয়ে নিশ্চয়ই হতাশ করবে না। এ আমাদের বিশ্বাস, এ আমাদের দাবি, এবং অবশ্যই আমাদের অধিকার।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ

বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাচ্চা বড় হয়েছে বলে মাকে বুড়ি সাজ নিতে হবে?
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে