চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক, নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবুজের ক্যানভাসে আঁকা এক মনোরম সড়কের দৃশ্য। দু’পাশে পাহাড়ের সারি, ঘন বৃক্ষরাজি, ছোট–বড় নদী এবং গ্রামীণ স্নিগ্ধতার এক অপূর্ব চিত্রমালা এই জনপদকে করেছে অনন্য। অথচ স্বপ্নযাত্রার অনিন্দ্য সুন্দর এই সড়কটিই সাম্প্রতিক সময়ে হয়ে উঠেছে অসংখ্য মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া এক ভয়ানক মরণফাঁদ। ভ্রমণ পথের সৌন্দর্য ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি, এই দুইয়ের অদ্ভুত সমীকরণই আজ এই মহাসড়কের প্রধান পরিচিতি। সড়কটি প্রশস্ত করার দাবিতে ইতিপূর্বে অনেক আন্দোলন ও লেখালেখি হয়েছে। তাই আমার এই লেখাকে চর্বিত চর্বণই বলা যায়। কিন্তু, যা কিছু সত্য ও প্রয়োজনীয় তা বারবার বলতে বা লিখতে ক্লান্তিবোধ করি না!
প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়কটি দেশের অর্থনীতি, পর্যটন ও মানবিক কার্যক্রমের জন্য মেরুদণ্ডস্বরূপ। প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ এই সড়কে যাতায়াত করেন এবং দেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার যাওয়ার প্রধান পথ এটি। তাছাড়া মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য ও ওষুধ এবং এই এলাকায় উৎপাদিত মাছ, লবণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সবকিছুই এই পথে পরিবহন করা হয়। অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক যুগের পর যুগ ধরে দুই লেনে অপ্রশস্ত অবস্থায় রয়ে গেছে। অর্থাৎ নামেই মহাসড়ক, বাস্তবে সরু রাস্তা! যার বেশিরভাগ অংশ মাত্র ১৮ থেকে ২২ ফুট প্রশস্ত, যা দেশের অন্যতম ব্যস্ত এ সড়কের জন্য একেবারেই অপ্রতুল। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা এখানে নিত্যদিনের চিত্র।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি থেকে আগস্ট) এই সড়কে ৬৫টি দুর্ঘটনায় ৯৮ জন নিহত ও ২৫৬ জন আহত হয়েছেন। আর গত পাঁচ বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৫০ ছাড়িয়েছে। পটিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চকরিয়ার মতো এলাকাগুলো এখন দুর্ঘটনার হটস্পট। সড়কের ২১টি পয়েন্ট চিহ্নিত হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে, কিন্তু কার্যকর সমাধান এখনো দূর অস্ত। দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সমস্যাগুলো মূলত অবকাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত।
তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: অপ্রশস্ত সড়ক ও ডিভাইডার না থাকা; ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও ঢালু অংশ; রাতে লবণের গাড়ি চলাচলের কারণে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া; অনিয়ন্ত্রিত গতি, আলোক স্বল্পতা ও অবৈধ যান চলাচল; তিনচাকার ছোট যানের অবাধ চলাচল; হাটবাজার ও জনবহুল এলাকা; দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত চালকদের এ সড়কে অনভ্যস্ততা; এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি ইত্যাদি। এই মহাসড়ককে নিরাপদ করার একমাত্র স্থায়ী সমাধান হলো অবিলম্বে এটিকে ছয় লেনে উন্নীত করা। এই দাবি দীর্ঘদিনের এবং এটি কেবল চট্টগ্রাম–কক্সবাজারের মানুষের দাবি নয়, বরং দেশের অর্থনীতি ও পর্যটন খাতের স্বার্থে একটি জাতীয় দাবি।
এই দাবিতে গত কয়েক বছরে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার শহর এবং উপজেলাগুলোতে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ বারবার রাস্তায় নেমে আন্দোলন ও মানববন্ধন করেছে। স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছেও। এ প্রেক্ষিতে গত এপ্রিলে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এ মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণের কার্যক্রম শুরুর কথা জানিয়েছিলেন। তবে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। তাই আশ্বাস নয়, এবার চাই বাস্তব পদক্ষেপ।
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কটি নিরাপদ ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে আরও একবার আলোচনা করা যেতে পারে।
প্রথমত, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ককে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ছয় লেনে উন্নীত করার জন্য প্রকল্পের কাজ শুরু ও শেষ করার সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তার আগে ছয় লেন না হওয়া পর্যন্ত অন্তত বিদ্যমান সড়কে ডিভাইডার স্থাপন করে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঝুঁকি কমাতে হবে।
এছাড়া দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকার বাঁকগুলোর নকশাগত পরিবর্তন করে রাস্তা সোজা করতে হবে; লবণের পানি পরিবহনে আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে; মহাসড়কে ছোট ও অবৈধ যান চলাচল বন্ধ এবং হাটবাজার ও জনবহুল এলাকায় আন্ডারপাস বা ওভারপাস নির্মাণ করতে হবে; কেরানীহাট, লোহাগাড়া ও চকরিয়ার মত উপজেলা সদরগুলোকে এড়াতে বাইপাস সড়ক নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি জোরদার করার জন্য স্মার্ট ট্র্যাফিক সিস্টেম চালু করতে হবে, এবং চালকদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
এই সড়ক সম্প্রসারণের দাবি যখন তুঙ্গে তখন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) লিগ্যাল নোটিশ নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সংগঠনটি চট্টগ্রাম–কক্সবাজার হাইওয়ে ইমপ্রুভমেন্ট (ফেজ–২) প্রকল্প বাতিল বা স্থগিতের দাবিতে ১৩টি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ পাঠিয়েছে। বেলার যুক্তি হলো, প্রকল্পটি চুনতি অভয়ারণ্য, ফাঁসিয়াখালী অভয়ারণ্য ও মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানসহ বিভিন্ন বনাঞ্চলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বন বিভাগও একই উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে যে সড়ক সম্প্রসারণের জন্য বনাঞ্চলের জমি কোনোভাবেই বরাদ্দ দেওয়া হবে না, বরং উড়ালসড়ক বা আন্ডারপাস তৈরির পরামর্শ দিয়েছে।
এখন পরিবেশ ও উন্নয়ন এ দুইয়ের মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য বজায় রাখতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে বসে যুগান্তকারী কোনো সমাধান বের করতে হবে। কেননা এই সড়ক সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প নেই। দেশের অর্থনৈতিক লাইফলাইনগুলোর মধ্যে অন্যতম এ মহাসড়কটিকে ছয় লেনে উন্নীত করলে শুধু দুর্ঘটনাই হ্রাস পাবে না, সাথে নিশ্চিত হবে অনেকগুলো সুবিধা ও ক্ষেত্র।
পর্যটন শিল্পের অভূতপূর্ব বিকাশ: বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার দেশের এক নম্বর পর্যটন গন্তব্য। প্রায় ১৫০ কিলোমিটারের এই পথ পাড়ি দিতে বর্তমানে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। মহাসড়কটি ছয় লেনে উন্নীত হলে যাতায়াতের সময় প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে, খরচও কমবে এবং সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে হবে, যা পর্যটক বৃদ্ধিতে সরাসরি ভূমিকা রাখবে।
বিনিয়োগ বৃদ্ধি: দ্রুত যোগাযোগ নিশ্চিত হলে দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কক্সবাজারের হোটেল, রিসোর্ট এবং অন্যান্য পর্যটন অবকাঠামোতে বিনিয়োগে আরও আগ্রহী হবেন। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হবে এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
কেবল আশ্বাস নয়, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নে সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। যাতে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং ভ্রমণ নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। তবে আমাদের বাস্তবতায় সড়কটির ছয় লেন দৃশ্যমান হওয়া বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আপদকালীন সমাধান হিসেবে ট্রাফিক তদারকি বৃদ্ধি, ঢালু ও বাঁক সরলীকরণ, ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে নজরদারি, জনবহুল এলাকায় ডিভাইডার ও ফুট ওভারব্রীজ নির্মাণ করা। পাশাপাশি বিশেষ ব্যবস্থায় লবণবাহী ট্রাক চলাচল নিশ্চিত করা, এবং চালক ও যাত্রীদের মাঝে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। সব পক্ষের বোধোদয় হোক, আর একটি প্রাণও সড়কে না ঝরুক।
লেখক: চেয়ারম্যান ইনচার্জ, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।












