চট্টগ্রাম পাহাড়, সমুদ্র আর সংগ্রামের শহর। এই নগরী শুধু বন্দর কিংবা বাণিজ্যের শহর নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেরও এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। আর এই মঞ্চে যার নাম অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে, যার কণ্ঠে একসময় দেশের রাজনীতির দিকনির্দেশনা নির্ধারিত হয়েছে তিনি বেগম খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রার শিকড় অনেকটাই প্রোথিত চট্টগ্রামের মাটিতে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক উত্থানের অন্যতম ভিত্তি ছিল এই বন্দরনগরী। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ এবং পরবর্তী সময়ে সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই অঞ্চল। এই চট্টগ্রামেই নির্মমভাবে খুন হন প্রেসিডেন্ট জিয়া। জিয়ার সেই উত্তরাধিকার বহন করে খালেদা জিয়া পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে আসেন। দলের নেতৃত্বে এসেও তিনি ভুলে যাননি চট্টগ্রামকে। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম–৮ (তৎকালীন) থেকে এমপি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। চট্টগ্রামের মানুষ ওই নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন তাঁকে। বিপুল ভোটের ব্যবধানে তিনি বিজয়ী হন। ওই নির্বাচনে খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলেন। পরে একটি আসন রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দেয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় তিনি চট্টগ্রাম–৮ আসনটি ছেড়ে দেন। এই আসনের উপনির্বাচনে তিনি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে মনোনয়ন দিলে তিনিও বিজয়ী হন। ফেনীর সন্তান বেগম জিয়া পার্শ্ববর্তী চট্টগ্রামের মীরসরাই আসন থেকেও একবার নির্বাচনে অংশ নেন এবং বিজয়ী হন।
চট্টগ্রামের মানুষের এই ভালোবাসার কথা মনে রেখেছিলেন খালেদা জিয়া। শুধু আন্দোলন সংগ্রামে নয়, যে–কোনো দুর্যোগ দুর্বিপাকেও তিনি চট্টগ্রামের মানুষের কাছে ছুটে আসতেন।
চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠ, পলোগ্রাউন্ড, কাজীর দেউড়ি এই স্থানগুলো শুধু ভৌগোলিক স্থান নয়, বিএনপির রাজনৈতিক স্মৃতির অংশ। হাজার হাজার নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে খালেদা জিয়ার ভাষণ এখানে অনেক সময় জাতীয় রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করেছে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হোক কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সংগ্রাম–চট্টগ্রাম ছিল তাঁর অন্যতম শক্ত ঘাঁটি।
চট্টগ্রামের মানুষ খালেদা জিয়াকে দেখেছে একদিকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে, অন্যদিকে একজন রাজনৈতিক সংগ্রামী হিসেবে। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি তিনবার সরকার গঠন করে এবং সেই সময় চট্টগ্রাম বন্দর, রপ্তানি অঞ্চল, সড়ক যোগাযোগ ও শিল্পায়নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া হয়। চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক গুরুত্ব তাঁর সরকারগুলোর সময়ে জাতীয় নীতিনির্ধারণে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল।
একইসঙ্গে এই শহরই খালেদা জিয়ার জন্য কঠিন সময়ের সাক্ষী। রাজনৈতিক সংঘাত, আন্দোলন–সংগ্রাম, মামলা মোকদ্দমা–সবকিছুর ছায়া চট্টগ্রামের রাজনীতিতেও পড়েছে। বিএনপির শক্তিশালী ঘাঁটি হওয়ায় এখানে সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার আর প্রতিবাদের দৃশ্যও বারবার দেখা গেছে।
আজ সময় বদলেছে, রাজনীতির ভাষা বদলেছে, কিন্তু চট্টগ্রামের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া এখনো একটি বড় অধ্যায়। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক ধারা এই শহরের রাজনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর উপস্থিতি কোনোদিন মুছে ফেলা যাবে না।












