মানব জাতির ইতিহাসে নদীর অববাহিকায় এবং সমুদ্রসংলগ্ন দেশেই মানুষের সভ্যতা সূচিত হয়েছে সবার আগে। সিন্ধু নদীর তীরে সিন্ধু সভ্যতা (মোহেনজোদারো হরপ্পা সভ্যতা), নীল নদীর তীরে ব্যাবিলনীয় সভ্যতাসহ বহু উদাহরণ এ প্রসঙ্গে দেয়া যায়। চট্টগ্রাম সমুদ্রসংলগ্ন ভূখণ্ড। সুতরাং তাই পৃথিবীর সমুদ্রসংলগ্ন দেশের ন্যায় এতদঞ্চলে চট্টগ্রামেই মানববসতি ও জনপদ সবার আগে গড়ে উঠবে, এ আর বিচিত্র কী। স্থলপথে চক্রযান আবিষ্কৃত হবার আগে সমুদ্রপথেই ব্যবসায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মানুষ দূর দূরান্তে দেশ দেশান্তরে পাড়ি জমাত। চট্টগ্রামেও প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই সমুদ্রপথে চট্টগ্রামে শুরু হয়েছিল নানা দেশের নানা জাতিসম্প্রদায়ের আনাগোনা এবং তার পরিণামে মানব সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ের দিকেই এই অঞ্চলেই মানবজাতির আবাসস্থল গড়ে উঠেছিল। স্বাভাবিক যে, বিশ্বের নানা দেশের প্রাচীন সমুদ্রবন্দর সংলগ্ন দেশসমূহই পরস্পরের সঙ্গে মানুষ অদলবদল করেছে। সমুদ্রসংলগ্ন এলাকার মানুষের রক্ত পরীক্ষা করলে এই সত্য ঠিকই ফুটে উঠবে।
চট্টগ্রামে জনবসতি মানবেতিহাসের কোন্ স্তরে সর্বপ্রথম দেখা দিয়েছিল, সেটা আজ বলা মুশকিল। সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে পাওয়া গিয়েছিল নব্যপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার।|(‘a piece of fossil wood, pointed, elongated, one side flat, truncated butt, beautifully polished looking like an ornamental sword’সেটা পরীক্ষা করে পণ্ডিতেরা অনুমান করে বলেছেন, খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর পূর্বেও এই অঞ্চলে মানুষের বসতি ছিল। কোন্ নরগোষ্ঠীর মানুষ সেই সময় এই অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন? সঠিকভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। হয়তো তারা ছিল অস্ট্রিক গোষ্ঠীর মানুষ কিংবা দ্রাবীড়; কিংবা উভয়ের সংমিশ্রিত। নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে এ বিষয়ে ভবিষ্যতে এ প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে। পণ্ডিতগণ মত প্রকাশ করেন, সে সময় ভূ-প্রকৃতি এবং অন্যান্য বিচারে নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মণিপুর, কাচার, মিজোরাম, ত্রিপুরা, সিলেট, আরাকান- ভারতের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের এই সকল দেশের সঙ্গে চট্টগ্রাম প্রায় সমচরিত্রের ছিল। এই বেল্টের অন্যান্য স্থানেও পাওয়া গেছে এরকম নব্যপ্রস্তর যুগের নিদর্শন। মনে করা হয়, এই অঞ্চলেই এই সময়ে সর্বপ্রথম এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। এদের পরে ব্যাপকভাবে আগমন ঘটে মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর এবং উল্লেখিত সমগ্র অঞ্চল জুড়ে এই জাতি বিস্তার লাভ করে। এই অঞ্চলে মধ্যপ্রাচ্যের সেমিটিকদের আনাগোনা শুরু হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই নৌপথে ব্যবসায়িক সূত্রে। এসমস্ত নানা জাতের নরগাষ্ঠীর রক্তের নানা অনুপাতের সংমিশ্রণে আজকের চট্টগ্রামবাসী জনগোষ্ঠী। নৃতাত্ত্বিক বিচারে তাই চট্টগ্রামবাসীর রক্তে পাওয়া যাবে পৃথিবীর সকল সমুদ্রসংলগ্ন দেশ ও জাতির নানা মানুষের রক্তের সমাবেশ। তাই বলা যায়, চট্টগ্রামের মানুষের এবং তাদের সংস্কৃতির চরিত্র বহুজাতিক (Cosmopolitan)।
খ্রিস্টজন্মের পরবর্তী কয়েকশ’ বছর চট্টগ্রাম ছিল ব্যাপকভাবে বৌদ্ধ অধ্যুষিত। যথেষ্ট চৈত্য ছিল বলে চট্টগ্রামের এহেন নাম (চৈত্যগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম), এরকম একটি মত চালু আছে। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে উল্লেখ করেছেন, সপ্তম শতাব্দীতে চট্টগ্রাম সিহলি চটলো তথা বৌদ্ধরাজ্য নামে অভিহিত হতো। তিনি যে সকল দেশের কথা তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে শ্রীচটলো তথা চট্টগ্রাম অন্যতম। জানা যায়, স্বয়ং বুদ্ধ সশিষ্য চট্টগ্রাম হয়ে বার্মায় গমন করেছিলেন। চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি তাঁর চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন তিনি ‘ছেলুইন নদীর তীর হইতে চট্টগ্রাম (চন্দ্রনাথ), হস্তীগ্রাম (হাইদগাঁও), আম্রগ্রাম (আমতলি) হইয়া জলপথে তিন মাসে কুশিনগরে উপস্থিত হন এবং তথায় তিনি নির্বাণ প্রাপ্ত হন।’ (১২৮২মগী: পৃ. ১৫) হাইদগাঁওয়ে সেসময়কার একটি প্রাচীন চৈত্য এখনো বর্তমান আছে। বর্তমানে অবশ্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের সে প্রাধান্য নাই। কীভাবে কোন্ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রামে বৌদ্ধজনগোষ্ঠীর এ সংখ্যা হ্রাস ঘটেছে, সেটা নিয়ে গবেষণা করার প্রয়োজন আছে। তবে বিশ্বব্যাপী বৌদ্ধ ধর্ম ও কৃষ্টি চর্চায় চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের প্রাধান্য যে এখনো রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান প্রবন্ধকার প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেই বলতে পারেন, উপমহাদেশ এবং বাইরের বৌদ্ধপ্রধান দেশসমূহে বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা এবং পৌরোহিত্য কাজে এখনো চট্টগ্রামের ভাংতেদেরই প্রাধান্য।
ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে চট্টগ্রামে মুসলমানদের আগমন ঘটেছে নবম দশম শতাব্দী থেকেই। বিজ্ঞ গবেষকদের মতানুসারে এই অঞ্চলে অষ্টম নবম শতক থেকেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলিম পীরমশায়েখদের আগমন শুরু হয়েছিল। অনেকে বলেন, এসময় দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলে (রম্যভূমি বা রামু) মুসলিম সুলতান শাসিত একটি রাজ্যও গঠিত হয়েছিল। চট্টগ্রামে রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদের আগমন ঘটে ১৩৩৮ সালে সোনারগাঁয়ের সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের চট্টগ্রাম বিজয়ের মধ্য দিয়ে। তাঁর এ চট্টগ্রাম বিজয় অবশ্য খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দ্বিতীয় বার মুসলিম বিজয় ঘটে ১৫২৫ সালে হোসেন শাহের পুত্র নসরত শাহের মাধ্যমে। চট্টগ্রামে তাঁর বিজয়ের বহু স্মারক ও নিদর্শন মসজিদ, দীঘি আজও চট্টগ্রামে সগৌরবে বিরাজ করছে। তবে ১৬৬৬ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁ চট্টগ্রাম দখল করে স্থায়ীভাবে তা মুসলিম শাসনাধীনে আনেন এবং চট্টগ্রামের নাম ইসলামাবাদ রাখেন। এর পরে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে চট্টগ্রামে সেমিটিকদের আগমন এবং তৎসঙ্গে ইসলাম প্রচার যথেষ্ট গতি লাভ করেছিল এতে কোন সন্দেহ নাই। বর্তমানে চট্টগ্রামে ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। শুধু তাই নয়, ইসলামচর্চায় চট্টগ্রামের মুসলমানগণ সমগ্রবঙ্গে শুধু নয়, এমন কি ইসলামী বিশ্বেও অগ্রণী অবস্থান নিয়ে আছেন। একবার শুনেছিলাম, মধ্যপ্রাচ্যে কোরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রামের ক্বারী প্রথম স্থান অধিকার করেন। মধ্যপ্রাচ্যেরই বহু মসজিদে চট্টগ্রামের মৌলবীরা ইমামতি করেন, সেরকম দুএকটা খবর এই প্রবন্ধকারের জানা আছে। আর্যীকরণের সময় এবং পরে অন্যভাবে অন্যান্য অঞ্চল থেকে হিন্দুরা চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করা শুরু করে এবং অচিরেই চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজদের স্থান পাকাপোক্ত করে নেয়। আধুনিক যুগে ভারতকাঁপানো বহু হিন্দু ব্যক্তিত্ব এই চট্টগ্রামেই জন্ম নিয়েছে। এবিষয়ে আমরা যথাস্থানে আলোকপাত করব।
বন্দর হিসেবে চট্টগ্রাম কবে থেকে তার কার্যক্রম শুরু করে সে প্রশ্নের জবাব আজকাল খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হবে। ইতিহাসের যুগ যখন থেকে শুরু হয়েছে, প্রায় তখন থেকেই আমরা নানা দেশের নানা পর্যটকের ভ্রমণবৃত্তান্তে চট্টগ্রামের উল্লেখ পাচ্ছি। ড. সুনীতিভূষণ কানুনগো তাঁর History of Chittagong (Vol.1)গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর সঙ্গে মৌখিক আলাপের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, নাব্যতা তথা জাহাজ ভেড়ার উপযোগী গভীরতা, পোতাশ্রয় তথা কর্ণফুলী নদীতে জাহাজ রাখার সুবিধা বহু প্রাচীন কাল থেকে ছিল বলেই চট্টগ্রাম সুদূর অতীত কালেই একটি প্রাকৃতিক সমুদ্রবন্দর হিসেবে উপযোগিতা অর্জন করেছিল। ‘বন্দর’ শব্দটি হচ্ছে একটি ফার্সিমূল শব্দ। অভিধান মতে এর একটি অর্থ হচ্ছে বাণিজ্যনগরী (Commercial Town ) এবং অন্য অভিধানমতে ‘সমুদ্রের বা বড় নদীর তীরে জাহাজাদি ভিড়াইবার স্থান’। চট্টগ্রাম বন্দর বিষয়ে অন্যতম বিশেষজ্ঞ গবেষক মিসবাহ উদ্দিন খান বলেন-‘চট্টগ্রামের মতই প্রাচীন চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাস।’ কেউ কেউ মনে করেন, চট্টগ্রাম বন্দরের শুরু খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে। (হাজার বছরের চট্টগ্রাম। দৈনিক আজাদী) চট্টগ্রামের প্রসঙ্গ, চট্টগ্রামের নামের উৎস ইত্যাদি নানা প্রকারের প্রায় ২০টি রেফারেন্স ড. কানুনগোর গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। তাঁর প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, কেউ বলছেন, চট্টগ্রামের প্রাচীন নাম ছিল পুষ্পপুর; ত্রিপুরার তিনটি পুরের অন্যতম পুর ছিল এই চট্টগ্রাম। কারুর মতে গ্রীক ভূগোলবিদ, ঐতিহাসিক টোলেমি (Ptolemy) পেন্টাপোলিস নামের যে সমৃদ্ধ বন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন, তাই হচ্ছে চট্টগ্রাম। ইরানী ঐতিহাসিকের বর্ণনায় এই শহর বর্ণিত হয়েছে ‘শহরে সব্জ্’ বা ‘সবুজ প্রকৃতিশোভিত নগরী’ হিসেবে। আদি মধ্যযুগের মুসলিম পর্যটক আল ইদ্রিসি (খ্রি. ১১০০-১১৬৫; জন্মস্থান বর্তমান স্পেনের সিউটা), ইবনে বতুতা (খ্রি. ১৩০৪-১৩৭৮; জন্মস্থান মরক্কো) প্রমুখের ভ্রমণবৃত্তান্তেও এই বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়। পর্তুগীজরা তো সরাসরি এই বন্দরকে Porto Grandiবা বড় বন্দর নামে স্পষ্ট উল্লেখ করেছে। কিছু লোকবিশ্বাসও আছে, যেমন- এক সময় চট্টগ্রাম ছিল জ্বিনপরীর আবাসস্থল। তাদের কাছ থেকে নামায পড়ার জন্য একটা চাটি বা প্রদীপ জ্বালাবার জায়গা চেয়ে নিয়েছিলেন অলৌকিক আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী আগত মুসলিম দরবেশ । সেই চাটির আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আজকের চাটিগাঁ। কোন্ কথা কতখানি সত্য সে কথা কেউ বলতে পারে না, কিন্তু এই সকল লোককথা কিংবদন্তী চট্টগ্রামের মহত্ত্বকে ঘোষণা করছে সগৌরবে।
‘আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান, সিনা দি ঠেগাই ঝড়তুয়ান।’ অসম্ভব প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা এই চট্টগামের মানুষ। তাদের প্রাণচাঞ্চল্যের পরিচয় রয়েছে সকল যুগের চট্টগ্রামের ইতিহাসে। সারেং, সুটকি, দরগা- এই তিনে চাটগাঁ। অতীত কালে চট্টগ্রামে যেমন ভিন্ন দেশের নানাজাতির নানা মানুষ এসে বসতি স্থাপন করেছে এবং চিরজীবনের জন্য এদেশের জনসমাজে ও প্রকৃতিতে মিলে মিশে একাকার হয়েছে, কে বলতে পারে, চট্টগ্রামের মানুষও আবহমান কাল থেকে কে কোথায় গিয়ে চিরদিনের জন্য সেখানকার হয়ে গেছে। কোন অসমর্থিত সূত্র থেকে বর্তমান প্রবন্ধকার জেনেছেন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের পূর্বপুরুষ একসময় চট্টগ্রামের পটিয়ার কিংবা রাঙ্গুনিয়ার অধিবাসী ছিলেন। একসময় পাল তোলা জাহাজের যুগ থেকে শুরু করে নৌ চালনায় চট্টগ্রামীদের যে প্রাধান্য ছিল, উক্ত ্শ্েলাকে তারই প্রমাণ বিধৃত আছে। এই প্রসঙ্গে সরের (আরবিমূল শব্দ। অর্থ ‘পাল’) জাহাজ তথা পাল তোলা জাহাজ নির্মাণের আকাশচুম্বী আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছিল, সে বিষয়ে কিছু তথ্য এ পর্যায়ে উপস্থাপন করা যেতে পারে। মধ্যযুগে এই জাহাজনির্মাণ শিল্পকে ঘিরে চট্টগ্রামে রচিত হয়েছিল এক সোনালী গৌরবময় অধ্যায়। আইনী আকবরীর মতে সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহর নৌ সদরদপ্তর ঢাকাতে অবস্থিত হলেও তাঁর নৌবহর ছিল চট্টগ্রামে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে তুরস্কের সুলতানের জাহাজের বহর তৈরি হতো চট্টগ্রামে। মাহুয়ান লিখেছিলেন, এই দেশের জাহাজের উচ্চমানের কারণে মহামান্য সম্রাট নিজস্ব জাহাজ নির্মাণের ব্যাপারে আলেকজান্দ্রিয়ার পরিবর্তে চট্টগ্রামকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এক ভ্রমণ কাহিনি থেকে জানা যায়, রোমের সুলতান চাটগাঁয় নির্মিত জাহাজে করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। তিনি সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণের জন্য চট্টগ্রামকে সেরা কেন্দ্র বলে উল্লেখ করেছিলেন। আরও জানা যায়, ওলন্দাজরা চাটগাঁর কারিগরদের নিকট থেকে তাদের যুদ্ধ জাহাজ কিনতো। ১৮৫৩ সালে বোর্ড অব রেভিনিউয়ের মিঃ কুরি উল্লেখ করেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর যতটা না বাণিজ্যের, তার চাইতে বেশি জাহাজের। জার্মানির ব্রেমার হেভেন যাদুঘরে চট্টগ্রামে নির্মিত একটি জাহাজ প্রদর্শনীর জন্য রক্ষিত আছে। হালিশহর, দমাখালী, গোসাইলডেঙ্গা ইত্যাদি জায়গা জাহাজ নির্মাণের জন্য সুপরিচিত ছিল। আধুনিক যুগে সম্প্রতিকালে বিদেশে সরবরাহের জন্য চট্টগ্রামে নতুন করে আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক প্রযুক্তি ও সুযোগসুবিধাসম্পন্ন জাহাজ নির্মাণ শুরু হয়েছে। অতীতকালের জাহাজ নির্মাণের সুবিপুল ঐতিহ্যর ধারাবাহিকতায় এই শিল্প চট্টগ্রামে আবার নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করবে বলে আমরা আশাবাদী। পোশাকে মসলিনের ঐতিহ্যর অধিকারী বাঙালি বর্তমানে আবার কি পোশাক তৈরিতে বিশ্ববাজারে উঠে আসে নাই? অতীত তো বসে থাকে না, ঠিকই গোপনে গোপনে কাজ করে যায়।
যে সময় বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাসমূহ রচনা করেছেন বলে মত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতসমাজ, সে সময়ই চট্টগ্রাম এবং তৎপার্শ্বস্থ জনপদসমূহ ব্যাপকভাবে বৌদ্ধঅধ্যূষিত ছিল বলে আমরা আগেই জেনেছি। আমাদের ধারণা, সে সময় চট্টগ্রামে অনেক চর্যাও রচিত হয়ে থাকতে পারে। চট্টগ্রামে সমসাময়িককালে আর্যায়ণ প্রক্রিয়া চলছিল। আর্যরা এদেশে খুব কম এসেছে, তবে তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব প্রবলভাবে এসেছে এখানে। আর্যায়ণ মানে আর্যঅনার্য দ্বন্দ্ব, যা, অনুমান করা যায়, সমসাময়িককালে বেশ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। আমাদের ধারণা তারই বিরূপ প্রতিফলন ঘটেছে নেপাল রাজদরবারের শৌরসেনী ভাষাভাষী অনার্যবিদ্বেষী আর্যদের চর্যাসংকলনে। তাছাড়া সে সময়কার নেপাল থেকে চট্টগ্রাম তথা নিম্নবঙ্গের ভৌগোলিক দূরত্বও কম ছিল না। মোট কথা মাত্র পঞ্চাশটি চর্যার (তন্মধ্যে সাড়ে ছেচল্লিশটি প্রাপ্ত) ভিত্তিতে কোন চূড়ান্ত মতামত তৈরি করাও সমীচীন হতে পারে না। এর মধ্যে আরও কিছু চর্যাপদ পাওয়া গেছে। এগুলোকে নবচর্যাপদ নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলোকে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করা গেলে এবং অনুসন্ধানের মাধ্যমে সেসময়কার আরও তথ্য পাওয়া গেলে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যাবে। তবে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের ব্যাপক অবদান সম্পর্কে কোন অস্পষ্টতা নাই। পৌরাণিক কাব্য, লৌকিক কাহিনী, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, পদাবলী, জ্যোতিষ শাস্ত্র ইত্যাদি মধ্যযুগের সকল সাহিত্যধারাতেই চট্টগ্রামের কবিসাহিত্যিকগণ অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। আহমদ শরীফের কয়েকটি উদ্ধৃতি দিলে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অংশিদারিত্ব ও ভূমিকার ব্যাপারে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। তিনি বলেছেন-‘ মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যে মুসলমানের রচনা বলতে প্রায় সবটাই তো চট্টগ্রামের দান, এমন কি বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চলের চাইতে হিন্দুর দানও কম নয়।’ তাঁরই হিসাব অনুযায়ী – ‘আঠারো শতকের প্রথমার্ধের আগে চট্টগ্রাম থেকে যেখানে পঞ্চাশ জন কাব্যকবিতা রচয়িতার সন্ধান পাওয়া গেছে, সেখানে নোয়াখালীতে পাওয়া গেছে একজন এবং কুমিল্লাতে তিন জন।’ (বর্তমান প্রবন্ধকার বাংলা একাডেমি প্রকাশিত শামসুজ্জামান খান ও সেলিনা হোসেন সম্পাদিত চরিতাভিধান এ ভুক্তি পর্যালোচনা করে লক্ষ্য করেছেন, মধ্যযুগের ৩৩জন কবির মধ্যে ১৫ জনই চট্টগ্রামের)। ড. আহমদ শরীফ তাঁর বিখ্যাত ‘বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে ‘মধ্যযুগের মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্য এবং চট্টগ্রাম’ শীর্ষক একটি আর্টিকেল সংযোজন করে এর সম্ভাব্য কারণ নির্দেশ করেছেন। এঁদের কয়েকজনের নাম আমরা সংক্ষিপ্ত পরিসরে উল্লেখ করতে পারি। এঁরা হলেন য়ুসুপ জলিখা কাব্যের শাহ মুহম্মদ সগীর, গোলে বকাওলি কাব্যের মুজম্মিল, মধুমালতী কাব্যে কবি মুহম্মদ কবির, মহাভারতের অনুবাদক শ্রীকরনন্দী, কালিকামঙ্গল কাব্যের কবি দ্বিজ মাধব, লায়লী মজনু কাব্যের দৌলত উজির বাহরাম খান, চন্দ্রাবতী কাব্যের কবি কোরেশী মাগন, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একমাত্র মুসলিম মহিলা কবি রহিমুন্নিসা এবং সর্বোপরি পদ্মাবতী কাব্যের কবি আলাওল প্রমুখ। এঁরা গুণে ও মানে বাংলার অন্য কোন অঞ্চলের চাইতে হীন তো ছিলেনই না, বরং অনেক ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতম সম্মানের অধিকারীও ছিলেন। কবি আলাওলের জন্মস্থান নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। জন্মসূত্রে আলাওল চট্টগ্রামের অধিবাসী যদি নাও হয়ে থাকেন (যদিও সে বিষয়ে এখনো গবেষকগণ নিঃসন্দিগ্ধ নন), এটা স্বীকার করার উপায় নাই যে, সে সময় চট্টগ্রাম সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় এতই খ্যাতির অধিকারী হয়ে উঠেছিল যে, আলাওল ও কবীন্দ্র পরমেশ্বরের (তিনি সপ্তগ্রামের অধিবাসী ছিলেন) মত বড় বড় মাপের কবিগণ চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক পরিবেশকে বেছে নিয়েছেন সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে ভাগ্যপরিবর্তন করার জন্য। মজার কথা হল এই যে, সে সময়কার চট্টগ্রামী ভাষাভাষী কবিরাও চট্টগ্রামের ভাষায় নয় বরং সর্ববঙ্গে প্রচলিত একটি সাধু সাহিত্যিক ভাষায়ই সাহিত্য রচনা করতেন, যদিও চট্টগ্রামের শব্দ, শব্দবন্ধ ও বিশিষ্টার্থক বাক্যাংশ সেখানে হয়তো বেশি ব্যবহৃত হতো। এসকল বিবেচনা করে আমরা স্বচ্ছন্দে বলতে পারি, অন্তত মধ্যযুগে চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছিল সমগ্র বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী ।
আধুনিক যুগে কোলকাতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বদৌলতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে দেখা দিলে চট্টগ্রাম তার প্রাধান্য হারায়। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম আধুনিক যুগেও তার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে। মহাকাব্যের কবি নবীন সেন, হামিদ আলী, গবেষণায় খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খান, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, অধ্যাপক যোগেশ চন্দ্র সিংহ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. আহমদ শরীফ, আবদুল হক চৌধুরী, সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যকর্মে মাহবুব উল আলম, আবুল ফজল, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, আসহাব উদ্দিন, আহমদ ছফা, শিক্ষাক্ষেত্রে ড. বেণীমাধব বড়ুয়া, ড. অরবিন্দ বড়ুয়া, ড. কালিকারঞ্জন কাননুগো,, ড, আবদুল করিম, রাজনীতি ও সমাজসেবায় মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেন, কাজেম আলী মাস্টার, লোকমান খান শেরওয়ানী, সঙ্গীতে সুরেন্দ্রলাল দাশ, জগদানন্দ বড়ুয়া নৃত্যে বুলবুল চৌধুরী, লোকসাহিত্যে আস্কর আলী পণ্ডিত, রমেশ শীলসহ অসংখ্য ব্যক্তিত্ব এই চট্টগ্রামের মাটিতে ভূমিষ্ট হয়েছেন, যাঁরা যে কোন বিচারে অখণ্ড উপমহাদেশীয় মাপের। ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রাম বরাবর তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ১৮৫৭ সালের তথাকথিত সিপাহী বিদ্রোহে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সিপাহীদের পদভারে কম্পিত হয়েছিল চট্টগ্রামের মাটিও। এই দেশে যখন দোর্দণ্ড ব্রিটিশ শক্তির শাসনকাল প্রায় দ্বিশত বর্ষ পূর্ণ হতে চলেছে তখন তার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের এই চট্টগ্রামের সূর্যসন্তানরা। স্বাধীনতার দুর্লভ স্বাদের জন্য যখন ভারতের প্রতিটি মানুষ উদগ্র লোলুপ, তখন চট্টগ্রামের মানুষকে স্বল্পসময়ের জন্য হলেও সে স্বাদটি চেখে দেখার সুযোগ দিয়েছিলেন তাঁরা নিজদের জীবনের বিনিময়ে। মাস্টারদা সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নির্মল সেন, লোকনাথ বল, অমরেন্দ্রনাথ নন্দী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, তারকেশ্বর দস্তিদার প্রমুখ। সালাম জানাই অনেক নাম না জানা সেদিনে সে সমস্ত শহীদদের। আমাদের এই প্রাণপ্রিয় বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রথম রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে অকুতোভয়ে আন্দোলনের অগ্নিপতাকা তুলে ধরেছিলেন চট্টগ্রামেরই তরুণ সংগঠক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম। বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারিতে যখন আমাদের সংগ্রামী তরুণদের বুক রক্তাক্ত করেছিল ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী শাসক, তখন সবার আগে তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে অকুতোভয়ে হাজির হয়েছিলেন চট্টগ্রামের কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। প্রবন্ধ লিখে তরুণ ভাষাপ্রেমীদের মনে সাহস যুগিয়েছিলেন, তাদের মননকে সমৃদ্ধ করেছিলেন চট্টগ্রামের প্রবন্ধকার ড. মুহম্মদ এনামুল হক, আবুল ফজল প্রমুখ। স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে চট্টগ্রামেই সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল লালদীঘির ময়দানে। চট্টগ্রামের মাটিতেই সূচনা হয়েছিল হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের । সামপ্রতিক কালে এই জাতির জন্য আর এক দুর্লভ সম্মান এনে দিয়েছে আমাদের এই চট্টগ্রামেরই সন্তান। বিশ্বসভা থেকে আমাদের জন্য নোবেলের মত মহান সম্মাননা ছিনিয়ে এনেছেন আমাদের সন্তান ড. মুহম্মদ ইউনূস। আমরা নোবেলজয়ী। সর্বমানবতার কল্যাণের কামনায় তিনি এখন সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছেন। সারা দুনিয়ার পণ্ডিত চিন্তানায়কগণ এখন তাঁর কথা মনোযোগ সহকারে শুনছেন, ভাবছেন, বিবেচনা করছেন।
মহাকাব্য রচনা সমাপ্ত হবে, কিন্তু চট্টগ্রামের গৌরবগাথা ফুরোবে না। সীমিত পরিসরে আজ তার কিছু ইঙ্গিত করা গেল মাত্র। চট্টগ্রামের গৌরবময় ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে এখন আমাদের উচিত হবে, চট্টগ্রামের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা। এই দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রামবাসীর ওপরই বর্তায়। তবে চট্টগ্রামের কথা চট্টগ্রামবাসীকে যেমন ভাবতে হবে, সেই সঙ্গে সারা দেশের মানুষকেও ভাবতে হবে। কারণ চট্টগ্রাম উন্নত হলে সারা দেশ লাভবান হবে। চট্টগ্রাম বাঁচলে সারা দেশ বাঁচবে। জয়তু চট্টগ্রাম।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক; অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। প্রাক্তন উপাচার্য, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কক্সবাজার।