আজ বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ধরা হয়েছে ‘এখনই সময় পদক্ষেপ নেয়ার’। ২০০৮ সালের ২৮ জুলাই বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে হেপাটাইটিস দিবস পালনের উদ্যোগ নেয় ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স’। ২০১১ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে প্রতিবছর ২৮ জুলাই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হেপাটাইটিস রোগ সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। হেপাটাইটিস ভাইরাসে বিশ্বে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যায়। আমরা লিভার নিয়ে তেমন একটা ভাবি না। যখন অসুস্থ হয়ে যাই, তখনই উদ্বিগ্ন হই। লিভারের জন্য আরেকটি ক্ষতিকর ভাইরাস হলো হেপাটাইটিস সি। লিভার সিরোসিসের ৩০ শতাংশ ও লিভার ক্যান্সারের জন্য ১৭ শতাংশ দায়ী হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। গর্ভবতী মায়েরা যদি হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে একই সঙ্গে মা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি মায়ের গর্ভের সন্তানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মায়ের অ্যাকিউট ইনফেকশন হলে এটা কখনো মারাত্মক পর্যায়ে চলে যেতে পারে। প্রচণ্ড জন্ডিসসহ আরও অনেক সমস্যা হতে পারে। জন্ডিসে মায়ের মৃত্যু হতে পারে। গর্ভের শিশু মারা যেতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা মাও মারা যেতে পারেন। গর্ভজটিলতা দেখা দিতে পারে। সন্তান প্রসবের সময় অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হতে পারে। সবকিছু মিলিয়ে গর্ভবতী মায়ের জন্ডিস বা হেপাটাইটিস বি একটা রেড অ্যালার্ট। অনেক সময় অপরিণত শিশু জন্ম নেয়। এই শিশু বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতে থাকে। একপর্যায়ে মা লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সারের দিকে যেতে পারেন। তবে আশার কথা হচ্ছে, এ রোগের ভ্যাকসিন আছে। এ ভ্যাকসিন খুব কার্যকর। দেশের সব শিশু–নারী–পুরুষের যদি ভ্যাকসিন নেওয়া থাকে, তাহলে আমরা সুরক্ষিত। যেসব মা সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ নিতে চান, যিনি অ্যান্টিনেটাল কেয়ারে যান, তাঁর ও তাঁর স্বামীর হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আছে কিনা, পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সব গর্ভবতী মাকে টিকা দেওয়া যাবে না। গর্ভবতী মায়েদের কিছু পরিস্থিতি বিবেচনা করে টিকা দেওয়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে প্রায় ১ কোটি মানুষ আক্রান্ত। বেসরকারি হিসাবে হেপাটাইটিসে প্রতি বছর ২০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় দেশে। হেপাটাইটিস নিয়ে উদ্বেগের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সারা বিশ্বে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে সংক্রমিত ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই জানেন না যে তার শরীরে এই ভাইরাস আছে।
লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ হেপাটোলজি সোসাইটির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জন্ডিস নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের শতকরা ৭৬ ভাগ হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত।
জানা গেছে, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ হেপাটাইটিস–বি ভাইরাস আবিষ্কার করেন, এইরোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করেন এবং টিকাকরণ শুরু করেন। চিকিৎসাবিদ্যায় তার এই অবদানকে স্বীকৃতি জানাতে ২৮ জুলাই তার জন্মদিনে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালন করা হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, বর্তমান বিশ্বে কভিড পরবর্তী প্রাণঘাতী হচ্ছে হেপাটাইটিস ভাইরাস। লিভার সিরোসিস এবং প্রাণঘাতী লিভার ক্যন্সার রোগের প্রধান কারণ হল হেপাটাইটিস ভাইরাস। প্রতি বছর ১৩ লক্ষ মানুষ এই ভাইরাসজনিত রোগে মারা যায় এবং এই মৃত্যুসংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ এই রোগের মাঝারি মাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। চট্টগ্রামে তেমন কোন সমন্বিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা না থাকলেও ছোট ছোট কিছু গবেষণা অনুযায়ী এই রোগের প্রাদুর্ভাব শতকরা ৪–৫ শতাংশ। হেপাটাটিস বি ও সি বাংলাদেশের একটি অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। দেশের প্রায় ৩.৫% গর্ভবতী মা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত। অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালন, অনিরাপদ অপারেশনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার, একাধিক ব্যক্তির একই সিরিঞ্জ ব্যবহার, অনিরাপদ যৌন মিলন এই রোগ সংক্রমণের বড় কারণ। রোগাক্রান্ত অধিকাংশ মানুষের কোন লক্ষন থাকে না এবং এই রোগের চিকিৎসাও দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল। তাই ব্যাপক জনসচেতনতার মাধ্যমে নীরব ঘাতক হেপাটাইটিস বি ও সি প্রতিরোধ করতে হবে এবং এজন্য সবাইকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।