চট্টগ্রামে হাইকোর্ট তথা হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে নানারকম তালবাহানা শুরু হয়েছিল আশির দশকে। এরশাদের কয়েকটি ভাল কাজের শ্রেষ্ঠ কাজটি ছিল ৬ স্থানে হাইকোর্ট স্থানান্তর। চট্টগ্রাম তার মধ্যে অন্যতম এবং চট্টগ্রামে হাইকোর্ট সত্যি সত্যি চলে আসায় ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীরা চোখে সর্ষে ফুল দেখলেন। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সুপ্রীম কোর্টে যে পরিমাণ ফিসের লেনদেন হয় কমবেশী অর্ধেক চট্টগ্রাম থেকেই। কোমড় বেঁধে নেমে গেলেন আশির দশকের ঢাকাস্থ নামকরা আইনজীবীরা। দেশ সেরা সিভিল ল’ইয়ার চট্টগ্রামের মোজাম্মেল হোসেন, ব্যাঙ্কিং বিশারদ শামসুল হুদা সহ চট্টগ্রামের আইনজীবীরা বললেন, ঢাকার বন্ধুরা নিতান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থে হাইকোর্ট ঢাকায় ফেরৎ নিতে চাচ্ছেন।
আমি আজও ভাবি এদেশের শিক্ষিত শ্রেণীর মত সুবিধাভোগী এবং স্বার্থপর মানুষ পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। জনগণের টাকায় এরা উকিল, জজ, ব্যারিস্টার হয়। অথচ সব সময় জনগণের পকেটের দিকেই এদের শকুনের দৃষ্টি। যে মামলায় পড়েছে সে’ই বুঝে হাইকোর্ট কাকে বলে। বাড়ি থেকে বের হয়ে কোনোমতে ঢাকায় পৌঁছলেন। এরপর পড়তে হবে ভাত আর থাকার হোটেলের খপ্পরে। তারপরের কাহিনী অতি সংক্ষিপ্ত। সিনিয়র আইনজীবী, জুনিয়র আইনজীবী, দ্রুত শুনানির তদ্বীরসহ ক্লার্ক, পিয়নের, সে কি দাপট! চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখলাম মামলায় পড়ে শুধু ঢাকার মামলা সামলাতে বহু মানুষের জমি বিক্রি হয়েছে। স্বর্ণ বন্ধক দিতে হয়েছে। ধার করতে হয়েছে বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে। আত্মীয়ের কাছ থেকে ধার নেয়ার কারণে আত্মীয়তা গোল্লায় গেছে জাগতিক নিয়মে।
ব্যভরিস্টার আমীরুল ইসলাম, তাঁর লণ্ডনী স্টাইলের বক্তৃতায় বলছিলেন, হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ যত ভাল কাজ’ই হোক, যেহেতু স্বৈরাচার সামরিক ফরমান বলে এই কর্ম করেছে সেহেতু সবার আগে এটা বাতিল করতে হবে। সব কোর্ট ঢাকায় ফেরৎ নিতে হবে। এরপর আমরা ক্ষমতায় গেলে পুনরায় সার্কিট বেঞ্চ আকারে বিভাগীয় সদরে ফেরৎ দেয়া হবে। একবারও কিন্তু বললেন না, জনগণের লাভ হয়েছে। কম পয়সায় মানুষ নিজ শহরে বিচার পাচ্ছে। স্বর্গীয় মোজাম্মেল হোসেন সহ যারাই তাদের কথার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছে, তাঁদের স্বৈরাচারের দোসর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ঢাকাস্থ বাঘা বাঘা আইনজীবীরা এবার এমন এক বুদ্ধি আবিষ্কার করলেন যার কাছে পরাজিত হলাম চট্টগ্রামসহ গোটা দেশের আইনজীবীরা। গোটা দেশের জনগণকে বোকা বানিয়ে হাইকোর্টে মামলা টুকে দেয়া হল। শেষ পর্যন্ত মামলা গড়াল আপীল বিভাগে। ৪জন বিচারপতির মধ্যে ৩জনের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বাতিল হলো হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ সংশ্লিষ্ট ২(ক)। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, সংশোধনীর ২য় অংশটি ঠিকই বহাল রয়ে গেল।
প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীসহ ৩ জন বললেন বাংলাদেশ ১টি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে একাধিক হাইকোর্ট থাকতে পারে না। আইন ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে প্রয়োজনে সার্কিট বেঞ্চ দেয়া যেতে পারে। দ্বিমত পোষণকারী বিচারপতি এটি এম আফজাল বললেন, ৮ম সংশোধনী সংসদের দু’তৃতীয়াংশ ভোটে পাশ হয়েছে। আইন প্রণয়ন ও সংবিধান সংশোধনে সংসদের ইচ্ছাই চূড়ান্ত। সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে সুপ্রীম কোর্ট ব্যাখ্যা দিতে পারে তবে পাশকৃত সংবিধান সংশোধন বা বাতিল করতে পারেনা এবং প্রয়োজনে গণভোট দিতে হবে এবং সংসদ যখন, সংবিধানের সংশোধনী আনয়ন করে, তাতে সুপ্রীম কোর্ট হস্তক্ষেপ করা সমীচীন নয়। তাছাড়া ৮ম সংশোধনীর হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ জনস্বার্থের বিজয় ঘোষিত হয়েছে, সুতরাং হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ বৈধ।
খুব কাছ থেকে দেখলাম এদেশের শিক্ষিত শ্রেণী কি চতুর পন্থায় জনগণকে ধোকা দেয়। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামের মানুষ রাস্তায় শুয়ে কাগজপত্র নিতে দেয়নি। রাস্তায় শুয়ে পড়েছিল শত শত আইনজীবী জনতা। অবশেষে অরিন্দম চলিল অন্ধকারে। গভীর রাতে আমরা যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন ডজন ডজন ট্রাকে করে আগ্রাবাদস্থ ভবন থেকে স্থানান্তর করা হল কাগজপত্র ও আসবাব সামগ্রী। সকাল বেলা উঠে যখন খবর শুনলাম মনে হল চট্টগ্রামের হৃদপিন্ড থেকে এক টুকরো মাংস ঢাকাইয়ারা খামচিয়ে নিয়ে গেল। আন্দোলনকারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিএনপি দু’দলের নেতারাই ছিলেন। একানব্বুই সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলো। নেতাদের অনেকেই এমপি হলেন, মন্ত্রী হলেন। দেখা হলেই সার্কিট বেঞ্চের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেই ত্বরিৎ জবাব একটু সময় দাও। হবে হবে। ক্ষমতার পালা বদল হলো। এলো আওয়ামী লীগ। ছিয়ানব্বই সালের মন্ত্রীসভায় ব্যক্তিগতভাবে চিনি অনেকেই মন্ত্রী, এমপি দেখা হতেই সার্কিট বেঞ্চের খবর জিজ্ঞেস করলেই বলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সহ জরুরি বিষয়গুলো শেষ হোক। পরে দেখা যাবে। এরপর আবার বিএনপি এলো ২০০১ সালে, জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না। ২০০৯ সালে এলো আবার শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগ। তিনি ২০১১ সালে চট্টগ্রামে সার্কিট বেঞ্চ দেওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতি বরাবরে একটি আগ্রহপত্র প্রেরণ করলেন। করিৎকর্মা খাইরুল হক সাহেব ফুলকোর্ট সভা ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সার্কিট বেঞ্চ ইস্যুটি স্থগিত করে দিলেন।
আমরা কিন্তু ক্ষান্ত হইনি। লেগে আছি চল্লিশ বছর ধরে। বর্তমান বিচার বিভাগ সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রসঙ্গটি উঠলো। সবদল একমত হলো হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণে কারো কোন আপত্তি নেই। তাও প্রায় দু’মাস হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে এবারও কেউ না কেউ পর্দার অন্তরাল থেকে সুতো নাড়ছে।
সংবিধানের ১০০ আর্টিকেল অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি ইচ্ছে করলেই আগামী সপ্তাহ থেকে সার্কিট বেঞ্চ চালু করতে পারেন। আর যদি সব বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থায়ী আকারে চালুর ইচ্ছে থাকে তবে রাষ্ট্রপতির একটি অর্ডিন্যান্স দিলেই কেল্লা ফতে। এক মাসের ব্যবধানে সব বিভাগীয় সদরে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ চালু সম্ভব। আগামী সংসদ অধিবেশনে বসার ৩০ দিনের মধ্যে পাশ হলে অর্ডিন্যান্সটি আইনে পরিণত হয়ে যাবে। সবদল যেহেতু একমত তাহলে ৩০০ সদস্যের করতালির মধ্য দিয়ে হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ অর্ডিনান্স পাস হবে।
আমরা মনে করি বর্তমান সরকার বড় কোনো কাজ সময় স্বল্পতার জন্য করতে পারেননি। এই একটি কাজ স্বল্প অর্থ ব্যয়, স্বল্প সময়ে করা সম্ভব। স্থায়ী বেঞ্চ সম্ভব না হলেও চট্টগ্রামে সার্কিট বেঞ্চ দিয়ে শুরু করা যেতে পারে।
সরকার এবং সমস্ত রাজনৈতিক দল একমত হওয়ার পরও করতে না পারার অর্থ হলো যারা সরকার নিয়ন্ত্রণ করে তাই এটি চাইছেন না। চাইবেন বা’ই কেন। অন্তত চট্টগ্রামে সার্কিট বেঞ্চ হলে বহু বন্ধুর আয়েসী জীবন, ঢাকা শহরে ছেলে মেয়ের পড়া, বিদেশে ছেলে মেয়ে পড়া, রাজনীতিতে ছড়ি ঘুরানো সহ বহু সুযোগ সুবিধার ব্যাঘাত ঘটবে। রুক্ষভাবে বললে বহু বন্ধুকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাড়াবাসা ত্যাগ করে পনেরো হাজারে নেমে আসতে হবে। জানি না চট্টগ্রামবাসী আর কতকাল, ঢাকা কেন্দ্রিক কতেক আইনজীবী ও সুবিধাভোগীদের সামনে, বিড়ালে থাবার নীচে ইঁদুর হয়ে থাকবেন। যদি এই সরকারের আমলে বাস্তবায়িত না হয় তবে বুঝবো আরেকবার প্রতারিত হলাম। অভিজ্ঞতা বলছে ভবিষ্যতের কোন রাজনৈতিক সরকার হাইকোর্ট দেবেন না, দেবেন না, দেবেন না।
লেখক: আইনজীবী আপিল বিভাগ, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব হাইকোর্ট বাস্তবায়ন পরিষদ।