‘টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন–২০২৫’ এ টিকা দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম শহর ও ১৫ উপজেলায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক শিশুর নিবন্ধন করেননি অভিভাবকরা। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত শহরে ৭৫ শতাংশ এবং উপজেলায় ৪৪ শতাংশ শিশু নিবন্ধন করেনি। অথচ বিনামূল্যে এ টিকা পেতে প্রয়োজন জন্মনিবন্ধন সনদের তথ্য (১৭ ডিজিট) দিয়ে ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করা। এছাড়া ক্যাম্পেইন সফল করতে শতভাগ নিবন্ধনের উপর জোর দিচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ। অবশ্য যারা নিবন্ধন করবে না তারাও টিকা নিতে পারবে। তবে তারা টিকা সনদ পাবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিবন্ধনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে স্কুলের শিক্ষকদের ভূমিকা বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের উচিত টিকা নিতে শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করা। একইসঙ্গে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। কারণ টাইফয়েড টিকা অত্যন্ত নিরাপদ। ‘ডেথ মলিকূল’ হওয়ায় এ টিকা শরীরে প্রবেশ করলে বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ারও আশঙ্কা নেই। এক ডোজ টিকা ৫ বছর পর্যন্ত শিশুকে নিরাপত্তা দেবে। তাছাড়া টাইফয়েডের এ টিকা বাংলাদেশে আগে থেকেই আছে। সচেতন লোকজন নিজ উদ্যোগে তাদের শিশুকে বেসরকারিভাবে এ টিকা দিয়ে থাকে। তবে এবারই প্রথম সরকারিভাবে দেয়া হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে ৯০ লক্ষ মানুষ টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার জন মৃত্যুবরণ করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্তের হার অনেক বেশি। দ্যা গ্লোবাল গার্ডেন অফ ডিজিজের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ৪ লক্ষ ৭৮ হাজার জন টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং ৮ হাজার জন মৃত্যুবরণ করে; যার ৬৮ শতাংশই শিশু।
জানা গেছে, নগরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এবং উপজেলায় সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে ক্যাম্পেইনে টাইফয়েড প্রতিরোধে টিসিভি (টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন) টিকা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী সকল শিশু এবং প্রাক্প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি বা সমমান পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে ১ ডোজ টাইফয়েড টিকা দেয়া হবে। আগামী ১২ অক্টোবর শুরু হবে ক্যাম্পেইন। এদিন থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ কর্মদিবস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থায়ী টিকাদান কেন্দ্রে এবং ১ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ৮ কর্মদিবস স্থায়ী ও অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্রে টিসিভি টিকা দেয়া হবে বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। তবে নগরে প্রথম দুই সপ্তাহ স্কুল পর্যায়ে এবং পরবর্তী ২ সপ্তাহ কমিউনিটি পর্যায়ে টিকা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। সংশ্লিষ্টরা জানান,www.vaxepi.gov.bd ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করা যাবে।
অর্ধেক শিশুর নিবন্ধনের বাইরে : চসিক ও সিভিল সার্জন সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পেইনে নগর ও উপজেলায় ২৪ লক্ষ ৬১ হাজার ৩৪২ জন শিশুকে টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। বিপরীতে গতকাল পর্যন্ত অনলাইনে ১১ লক্ষ ১০ হাজার ৬৭৯ জন শিশুর নিবন্ধন হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ উপজেলায় ১৬ লক্ষ ৩২ হাজার ৪১ জন শিশুকে টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও গতকাল ১১টা পর্যন্ত নিবন্ধন হয়েছে ৯ লক্ষ ৮ হাজার ৬২৫ জনের। যা লক্ষ্যমাত্রার ৫৬ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিবন্ধন হয়নি ৭ লক্ষ ২৩ হাজার ৪১৬ জন শিশুর।
এদিকে নগরে ৮ লক্ষ ২৯ হাজার ৩০১ জন শিশুকে টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে গতকাল পর্যন্ত ২ লক্ষ ২ হাজার ৫৪ জন শিশুর নিবন্ধন হয়েছে বলে আজাদীকে জানিয়েছেন চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমাম হোসেন রানা। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমরা প্রচারণা চালাচ্ছি। সেখানে নিবন্ধন করতে শিক্ষকরা সহযোগিতা করছেন। কমিউনিটি পর্যায়েও প্রচারণা চালাচ্ছি। কিন্তু কর্পোরেশনের বাইরে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে সেখানে নিবন্ধন করার হার কম। আমরা সেখানকার শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। শিক্ষকরা আরেকটু ভূমিকা রাখলে নিবন্ধনের হার বাড়বে।
এদিকে ক্যাম্পেইন উপলক্ষে গতকাল চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের ওরিয়েন্টশন সভায় গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফায়জুল হক বলেন, ক্যাম্পেইন নিয়ে দুটো চ্যালেঞ্জ। প্রথমত শতভাগ রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করা এবং গুজব এড়িয়ে ক্যাম্পেইন সফল করা। তিনি বলেন, একসময় গুঁটিবসন্তে মানুষ মারা যেত। এখন সেটা নেই। টিকার কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। টিসিভি টিকা শতভাগ নিরাপদ ও হালাল।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ৪১টি ওয়ার্ডে ১ হাজার ৫৪৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ৭৮৩টি আউটরিচ সাইটে টিকাদান কর্মসূচি চলবে। এর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লক্ষ্যমাত্রা ৫ লক্ষ ৩১ হাজার ১৬৭ এবং স্কুলবহির্ভূত কমিউনিটিতে ২ লক্ষ ৯৬ হাজার ৭৮৪ জন শিশুকে টিকা দেওয়া হবে। টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনায় স্কুল ক্যাম্পেইনে ভ্যাকসিনেটর আছেন ৪২০ জন, কমিউনিটি ক্যাম্পেইনে ভ্যাকসিনেটর ২১৫ জন, স্কুল ও কমিউনিটি ক্যাম্পেইনে স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন ৬২৫ জন করে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পেইন পরিচালনায় মোট জনবল আছে ৩ হাজার ৬৭৫ জন। এর মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক ১ হাজার ৮০০ জন এবং টিকাকর্মী ১ হাজার ২১৫ জন।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, টাইফয়েড প্রতিরোধে টিসিভি খুবই নিরাপদ ও কার্যকরী। বিশ্বব্যাপী এই টিকা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই শিশুরা গ্রহণ করছে। পাকিস্তান, নেপাল ও বিভিন্ন দেশে এই টিকা প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যবহৃত টিসিভি টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক যাচাইকৃত। টিসিভি টিকা দেওয়ার পর সামান্য প্রতিক্রিয়া, যেমন টিকা দেওয়ার স্থানে চামড়া লাল হওয়া, ফুলে যাওয়া, সামান্য ব্যথা, অল্প জ্বর, মাথা ব্যথা, ক্লান্তি ভাব এবং মাংসপেশিতে ব্যথা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। তবে ওগুলো এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান থাকবে তারা যেন দ্রুত রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করে তাদের শিশুদের টিকা দেয়া নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, ২ বছর এবং তার কম বয়সী শিশুদের শূন্য দশমিক ৫ এমএল পরিমাণ টিকা উরুর মধ্যভাগের বাইরের অংশের মাংসপেশিতে এবং ২ বছরের অধিক বয়সীদের বাহুর উপরিভাগে বাইরের অংশে সমপরিমাণ ডোজ ডেল্টয়েড মাংসপেশিতে প্রদান করা হবে।