চট্টগ্রামে রেলকর্মীদের কোয়ার্টার নিয়ে চলছে অবৈধ ভাড়া বাণিজ্য। নিজেদের থাকার নামে বাসা-বাড়ি বরাদ্দ নিয়ে এর চারপাশের জায়গায় বাসা-বাড়ি-দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়ার অভিযোগ অনেক পুরনো। এছাড়া এসব ভাড়া বাসা মাদক স্পট হিসেবে যে ব্যবহৃত হচ্ছে তা রেল কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন। মানভেদে এসব বাসা ভাড়া দেয়া হচ্ছে সাত থেকে
১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। কোয়ার্টারের খালি বাসা ঘিরেই বাণিজ্য চলছে না, আশপাশে অস্থায়ী ঘর বানিয়ে দেয়া হচ্ছে ভাড়া। রেলের জায়গায় এমন ৩০ হাজারেরও বেশি অবৈধ ঘর তুলে তা থেকে প্রতি মাসে অন্তত ৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সুবিধাভোগী চক্র। এতে জড়িত আছে রেলের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী আর স্থানীয় প্রভাবশালী। চট্টগ্রামে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ত্রিশটি কলোনির চিত্রই কম-বেশি এমন। তাতে কোয়ার্টারের সব জায়গাতেই অবৈধ টিনশেড ঘর ও দোকান। রেলকর্মীদের জন্য যেখানে পাঁচ হাজার ইউনিট বাসা রয়েছে, সেখানে এমন অবৈধ ঘর রয়েছে অন্তত ত্রিশ হাজার। বাসা বরাদ্দ পাওয়া রেলকর্মী এবং স্থানীয় প্রভাবশালীরা খালি জায়গা পেলেই তুলছে ঘর। ভাড়া দিচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষদের। আর তাদের একটি অংশ মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে।
বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী আজাদীকে বলেন, বরাদ্দ পাওয়া কোয়ার্টারে ভাড়া বাণিজ্য এবং সেখানে মাদক ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ আমাদের কাছেও আসে। অভিযোগ পেলে আমরা অ্যাকশনে যাই। অথবা রেলের সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টকে জানাই। আমরা বর্তমানে এ ধরনের অবৈধ এবং অপরাধমূলক বাসাগুলোকে চিহ্নিত করছি। শীঘ্রই উচ্ছেদ চালানো হবে। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত, উচ্ছেদ চালানোর পর জায়গাগুলো খালি রাখা যাবে না। কিছু না কিছু করতে হবে।
তিনি বলেন, রেলের এমন অবৈধ বাসাবাড়ি, দোকান উচ্ছেদ অভিযান আজও (রোববার) চলেছে। আগামীকালও চলবে। রোববারের উচ্ছেদ অভিযানে গোয়ালপাড়া এলাকায় ৩ হাজার অবৈধ দখলদারকে বিতাড়িত করে ১ দশমিক ৭৭ একর জায়গা উদ্ধার করা হয়েছে।
গতকাল রোববার ও তার আগের দিন শনিবার নগরীর চারটি রেলওয়ে কলোনি ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য উঠে এসেছে।
নগরীর সদরঘাট থানার সাবেক ওসি (বর্তমানে কোতোয়ালী থানার ওসি) মো. নেজাম উদ্দিন আজাদীকে বলেন, বরিশাল কলোনির মাদক স্পট উচ্ছেদকালে আমি দেখেছি, মাদক লুকিয়ে রাখতে কলোনির এসব কোয়ার্টারকে ব্যবহার করা হতো। তখন আমি প্রতিটি কোয়ার্টারের লিস্ট করেছি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি উচ্ছেদের। মাইকিং করে ভাড়াটিয়াদের আলটিমেটাম দিয়েছি। তখন ভাড়াটিয়ারা চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমি অন্য থানায় চলে আসার পর শুনেছি, আবারো স্টেশন কলোনিটি পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছে।
নগরীর টাইগারপাস রেল কলোনির তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের কোয়ার্টারে গিয়ে দেখা গেছে, বাসাটি পরিত্যক্ত। তাই বিদ্যুতের মিটারও নেই। কিন্তু ভেতরে মানুষের উপস্থিতি ঠিকই আছে, চলছে ফ্যান-লাইট। এসব বাসায় অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ লাগিয়ে মাসের পর মাস বিদ্যুৎ ব্যবহার করলেও সরকারি কোষাগার থেকে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ দেখিয়ে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ লাগিয়ে মিটারবিহীন গ্যাসের বিল দুর্নীতির মাধ্যমে অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের কাঁধে ঝুলিয়ে দিচ্ছে। এতে সরকার হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব। এই অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে সম্প্রতি গোয়ালপাড়ার তুলাতলীতে অবৈধ দখলদার ও মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে রক্তাক্ত হয়েছেন এক প্রকৌশলীসহ রেলের কয়েকজন কর্মচারী।
নগরীর বয়লার কলোনি ঘুরে দেখা গেছে, দুই রুম বিশিষ্ট একটি কোয়ার্টার ভাড়া দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার টাকায়। আর কোয়ার্টারের চারপাশে অবৈধভাবে ছোট ছোট রুম তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে আরো সাতটি পরিবারকে। সর্বমোট এ কোয়ার্টার থেকে আয় হচ্ছে ৩৬ হাজার টাকা। পাশাপাশি বছরের পর বছর দখল করে এখানে চলে মাদক ব্যবসা, ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম।
ইতোমধ্যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেল কর্মকর্তাগণ। নগরীর পুরাতন রেলস্টেশন কলোনিতে রেল সংশ্লিষ্ট শাহ আলম নামে এক ব্যক্তির বড় ভাইয়ের দুটি কোয়ার্টার, ছোট ভাইয়ের একটি কোয়ার্টার এবং তার শ্যালকের নামে বরাদ্দ আছে একটি কোয়ার্টার। শুধু এটিই নয়, প্রতিটি কোয়ার্টারের সামনে আছে সারি সারি টিনশেড ঘর।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কতিপয় প্রভাবশালী কর্মকর্তা-কর্মচারী চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ ডেবার পাড়, ঝাউতলা আমবাগান, সিআরবি, কদমতলী, টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনি, আইস ফ্যাক্টরি রোড, পাহাড়তলী জোড় ডেবা, গোয়ালপাড়া তুলাতলী, বয়লার কলোনি ও ভেলুয়ার দিঘির পাড়সহ বিভিন্ন স্থানে রেল বিভাগের বিপুল পরিমাণ জায়গা দখল করে শত শত বাসা-বাড়ি তৈরি করেছে।
ঝাউতলা আমবাগান এলাকার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেলের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চট্টগ্রাম রেলওয়ে কলোনি ও পাহাড়তলী আমবাগান রেলওয়ে কলোনিসহ বিভিন্ন জায়গায় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর বাসভবন দখল করে তাতে বহিরাগত ভাড়াটিয়া বসিয়ে বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ সরকারের খাতায় এ পর্যন্ত এক টাকাও জমা করেনি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কখনো কখনো কোয়ার্টারগুলো কেনাবেচা চলে। যেমন যার নামে কোয়ার্টার তিনি দুই লাখ টাকা দিয়ে লিজ দিলেন। শর্ত হলো ভাড়া যা উঠবে তা অর্ধেক অর্ধেক ভাগ হবে।












