জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিয়মিত বই পড়তেন। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। সে সময় তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল বই। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ পাঠ করে আমরা তাঁর বইপাঠের স্পৃহা সম্পর্কে জানতে পারি। বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন চারদিকে শুধু নেই আর নেই। সারাদেশে রাস্তাঘাট, সড়ক – মহাসড়ক, ব্রিজ– কালভার্ট সব বিধ্বস্ত। রাষ্ট্রীয় কোষাগার শুন্য। দেশ পুনর্গঠনে যখন সরকার হিমশিম খাচ্ছে সে রকম সময়েও বঙ্গবন্ধু বই পাঠকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন নি। তিনি গঠন করেছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। সে সময় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের লোকবল ও সামর্থ তেমন না থাকলেও সারাদেশে বইপড়া আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। এর পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েন উদ্দীন। তিনি তখন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে কর্মরত। ‘বই হোক নিত্যসঙ্গী’, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে ‘বই কিনুন– বই পড়ুন’ আন্দোলনের একটি ঢেউ তখন সৃষ্টি হয়েছিল। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বইমেলার প্রবর্তন করে এবং গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ‘জাতীয় গ্রন্থমেলা’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল চট্টগ্রামে। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত এই গ্রন্থমেলায় দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠিত কবি– লেখক– সাহিত্যিকদের পাশাপাশি তরুণ– নবীন লিখিয়েরাও নানাভাবে সংযুক্ত হয়েছিলেন।
তখন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘খেলারাম খেলে যা’ নিয়ে গ্রন্থমেলায় আলোচনা– সমালোচনা ছিল তুঙ্গে। সরদার জয়েন উদ্দীনের পরিচালনায় মেলামঞ্চে প্রতিদিন বিকেলে ‘ধারাবাহিক গল্পবলার আসর’ বসত। মূলত যারা নতুন লেখক তাদেরকে এখানে সুযোগ দেয়া হত। সরদার জয়েনউদ্দীন কয়েকটি চরিত্র নিয়ে গল্পের সূচনা করে দিতেন। পরবর্তী জন তা টেনে নিতেন। পুরো মেলা চত্বর দিনরাত বইপ্রেমীদের পদচারণায় মুখর থাকত। আমি তখন গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে থাকা শুরু করেছি কাজীর দেউড়ি ২ নম্বর গলির একটি মেসে। গলির মুখে নামকরা একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। সেটির নামানুসারে লোকজন গলিটিকে ‘গেইট অব লন্ডন গলি’ বলে বলত। শহরে বসবাসের সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলাম সকাল–সন্ধ্যা গ্রন্থমেলায় কাটিয়ে। মূলত সেই থেকে নিয়মিত বই কেনার অভ্যেসটা গড়ে ওঠে বলা চলে। আমি এখানে আমার প্রয়াত শ্রদ্ধাভাজন পিতা এয়াকুব আলী চৌধুরীকে কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করতে চাই। আমাদের সময়ে স্কুল– কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ‘আউট বই’ পড়াটা যখন গর্হিত অপরাধ বলে বিবেচিত হত (সিলেবাস বহির্ভূত বইকে আউট বই বলা হত) সেই রকম সময়ে যখন আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তখন একদিন শহরের কাজ শেষে বাড়ি ফিরে আমার হাতে একটি বই তুলে দিয়ে বাবা বলেছিলেন, ‘বইটি পড়বি, ভাল লাগবে’। বইটি ছিল আবুল মনসুর আহমদের ‘ফুড কনফারেন্স’। গল্প সংকলন এটি। ৫৫ বছর আগে পড়া বইটির মর্মকথা এখনও মনে গেঁথে আছে।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে ১৯৭৫ সালে যখন জাতীয় গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল সেই একই সময়ে আরও একটি জাতীয় ইভেন্ট চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয়। সেটি ছিল জাতীয় অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতা। বর্তমান এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে বর্ণাঢ্য এই ইভেন্টে সারাদেশের অ্যাথলেটরা অংশ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সরকার তখন দু– দুটি জাতীয় ইভেন্টের জন্য চট্টগ্রামকে নির্বাচিত করলেও এর কিছুদিন পর ১৫ আগস্ট ঘৃণিত ঘাতক চক্রের হাতে জাতির জনক সপরিবারে নিহত হলে দেশ পশ্চাদপতার দিকে ধাবিত হতে থাকে। পাকিস্তানি ভাবধারা প্রতিষ্ঠায় প্রতিক্রিয়াশীল চক্র উঠে পড়ে লাগে।
১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ঢাকায় যে বইমেলার শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়, তা আজ আমাদের ঐতিহ্য ও অহংকারের অংশ। কিন্তু চট্টগ্রাম দেশের দ্বিতীয় নগরী এবং শিল্প– সাহিত্যের সূতিকাগার হলেও এখানে একটি বইমেলার অভাব তীব্রভাবে উপলব্ধি করতে থাকেন সংশ্লিষ্টরা। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চট্টগ্রামে বইমেলার কোনো আয়োজন না হওয়ায় এখানকার সৃজনশীল প্রকাশক, লেখক, সাহিত্যপ্রেমী বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে ডিসি হিল, মুসলিম হল চত্বর এবং লালদিঘি ময়দানে একাধিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। পরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন উদ্যোগ নিয়ে সবপক্ষকে একছাতার নিচে এনে চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম জিমনেশিয়াম মাঠে একটি মাত্র বইমেলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। যা এখনও চলমান। চলতি ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এই বইমেলার উদ্ধোধন করেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। চট্টগ্রামের বাসিন্দারা ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভাল’ বলে আপাতত সন্তুষ্টি লাভ করছে।
তবে চট্টগ্রামের প্রকাশকরা মনে হল তেমন সন্তুষ্ট নন। আলাপে জানা গেল এই বইমেলায় তারা প্রকৃতপক্ষে তেমনটা উপকৃত হচ্ছেন না। কারণ অনেক স্টল তাদের নিজস্ব প্রকাশনার চেয়ে বিভিন্ন সংস্থার বইয়ের সমাহার ঘটিয়েছেন। ভারতীয় বইও দেদারসে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন স্টলে। এটিকে বারোয়ারি বইমেলাও বলছেন অনেকে। প্রশ্ন থেকে যায় ঢাকার মত চট্টগ্রামেও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কেন একটি পরিপূর্ণ বইমেলার আয়োজন হবে না। কেন এখানকার প্রকাশক– লেখকদের চাঁদা তুলে বইমেলার আয়োজন করতে হবে। বাংলা একাডেমি ঢাকায় বইমেলা করে আর কোনো চাপ নিতে পারবে না –এটি যদি বলা হয়, তাহলে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বা গণগ্রন্থাগার অধিদফতরের মাধ্যমে চট্টগ্রামে কি বইমেলা আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া যায় না? জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে বর্তমানে পরিচালক পদে রয়েছেন কবি–সাংবাদিক মিনার মনসুর। চট্টগ্রামের সন্তান হিসেবে তিনি এ ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন এমনটা প্রত্যাশা আমরা করতে পারি।
বর্তমান সরকার পুরানো মুসলিম হল এবং পাবলিক লাইব্রেরি ভেঙে নতুন করে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করছে। সাথে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারও নির্মিত হচ্ছে নতুনভাবে। এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। কমপ্লেক্সটি চালু হলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরিটি হবে দেশের সর্ববৃহৎ গণপাঠাগার। এতবড় পাঠাগার কোনো কাজে আসবে না যদি পাঠকের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা না যায়। পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার পেছনে বইমেলা কার্যকর ভূমিকা রাখে এটি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই চট্টগ্রামে আগামীতে বইমেলা হোক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়– একজন লেখক হিসেবে এই চাওয়াটা কি খুব বেশি হয়ে যায়। আশা করছি, মেধা– মনন ও সৃজনশীলতার বিকাশ এবং সামাজিক অবক্ষয় রোধে বিষয়টি বিবেচনায় নেবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল তথা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।