দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল, কিন্তু রোদের প্রখরতা একই। গা পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। রিকশা থামাতে বাধ্য হলেন ২৮–৩০ বছরের যুবক সোহেল মিয়া। দোকান থেকে পানির বোতল কিনে পান করলেন। রিকশায় থাকা যাত্রীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। যাত্রীও হাত বাড়িয়ে নিলেন।
গতকাল শনিবার নগরীর গনি বেকারির মোড়ে দেখা গেছে এ চিত্র। শুধু সোহেল মিয়া নন, নানা কাজে যারা রাস্তায় বেরিয়েছেন আর যারা ঘরে অবস্থান করছেন, কয়েকদিনের টানা তীব্র গরমে সকলের জীবন হাঁসফাঁস। গতকাল নগরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এটা চট্টগ্রামে এ মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এ খরতাপ থেকে শিক্ষার্থী থেকে দিনমজুর, গাড়ির চালক, যাত্রী, ফেরিওয়ালা, চাকরিজীবী কেউই রক্ষা পাচ্ছেন না।
কর্ণফুলী নদীর কল্পলোক আবাসিক ঘাটে সাম্পান ভিড়িয়ে একটি ছাউনিতে বসেছিলেন মাঝি অমল। তখন দুপুর সাড়ে ১২টা। এ সময় যাত্রী নিয়ে যাওয়ার চিন্তাও করতে পারছিলেন না তিনি। তিনি বলেন, খুবই দুর্বল লাগছে। নৌকায় হাত দিতেও ইচ্ছা করছে না। সকালে দু’বার যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে গিয়েছিলাম। যা গরম পড়ছে! তৃতীয়বার যাত্রী নৌকায় তোলার সাহস পাচ্ছি না। তাই এখানে বসে আছি। ঘর থেকে ২ লিটারের বোতলে করে পানি এনেছেন জানিয়ে বলেন, এখন বোতলের পানি শেষ হয়ে গেছে। তৃষ্ণা পেয়েছে। ভাবছি পানির জন্য দোকানের দিকে যাব। তীব্র গরমের কারণে যাত্রীও কমে গেছে বলে জানান তিনি।
নগরীর আন্দরকিল্লা মোড়ের ফল বিক্রেতা জসিম উদ্দিন মাথায় গামছা বেঁধে ফল বিক্রি করছিলেন। একটু পরপর তিনি গামছাটি দিয়ে ঘাড় ও মুখ মুছছিলেন। মাঝে মাঝে গামছা দিয়ে হাত পাখার মতো বাতাস করছিলেন। তিনি বলেন, কিছুই করার নেই। গরম সহ্য করতে হচ্ছে। আমার ইনকাম দিয়েই সংসার চলে। বেচা–বিক্রি না করলে তো হবে না। তিনি বলেন, স্বাভাবিকের চেয়ে ক্রেতার সংখ্যাও কমে গেছে। গরমের কারণে এটি হয়েছে। মানুষ ঘর থেকে কম বের হচ্ছেন। গতকাল নগরীতে রাজনৈতিক দলের সমাবেশ ছিল। এর জেরে নগরজুড়ে যানজটও ছিল। অনেক যাত্রীকে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। অনেকে দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও গাড়ি পাননি। দুপুর আড়াইটার দিকে কাজীর দেউড়ি মোড়ে দাঁড়িয়েছিলেন হোসেন মিয়া নামে এক ব্যক্তি। তিনি সিএনজি টেক্সি খুঁজছিলেন। যাবেন চান্দগাঁওয়ের রাস্তার মাথা এলাকায়। তিনি বলেন, ১৫ মিনিটের মতো হবে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু কোন গাড়ি পাচ্ছি না। অন্তত বহদ্দারহাট মোড় পর্যন্ত যদি যেতে পারতাম! সেখান থেকে অন্য একটি গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে যেতাম। কোনো লোকাল গাড়িও দাঁড়াচ্ছে না। যাত্রীর চাপ অনেক। আগ্রাবাদ থেকে যেসব টেম্পো আসছে সেগুলো দাঁড়াচ্ছে না।
চট্টেশ্বরী এলাকার বাসিন্দা নুর নবী বলেন, তীব্র তাপদাহে ঘরেও থাকা যাচ্ছে না। দুপুরের দিকে একটু ঘুমাচ্ছিলাম। ফ্যান চলছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে। দেখি শরীর ঘেমে গেছে। গায়ে থাকা টি–শার্টও ভিজে গেছে। বাধ্য হয়ে উঠে পড়লাম। তিনি বলেন, একটু বের হব ভাবছিলাম। সদরঘাটে কাজ ছিল। কিন্তু বের হতে ইচ্ছে করছিল না।
ইস্পাহানী মোড়ে বাস চালক রহমত উল্লাহ জানান, বাজে অবস্থা। যানজট রয়েছে। এর মধ্যে প্রচুর গরম। যাত্রীরা চেঁচামেচি করছেন। একজনের গায়ে আরেকজন লাগলেই রেগে যাচ্ছেন। আমার সহকারীর সাথেও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মেজাজ দেখাচ্ছেন যাত্রীরা। আমরাও মেজাজ ঠিক রাখতে পারছি না। এভাবেই চলছে। আসলে গরমে মানুষ অতিষ্ঠ।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গতকাল মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রত্যক্ষ করেছে চট্টগ্রামবাসী। আগের দিনও একই অবস্থা ছিল।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস কর্মকর্তা মো. ইসমাইল ভূঁইয়া আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামে দুদিন ধরে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। গতকাল শনিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ২৮ দশমিক ২ ডিগ্রি। চট্টগ্রাম অঞ্চলে মে মাসে সাধারণত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে থাকে। দুদিন ধরে সেই মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি আরও তিন দিন চলতে পারে।
তিনি বলেন, ১২ মে’র পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে পারে। তখন গরম থাকলেও এ ধরনের অসহনীয় পরিস্থিতি কিছুটা কমবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ৩৬ ডিগ্রি থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ ডিগ্রি থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে মাঝারি তাপপ্রবাহ, ৪০ ডিগ্রি থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং ৪২ ডিগ্রি ও এর উপরের তাপমাত্রাকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চলতি মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। গতকাল এ জেলায় তাপমাত্রার পারদ ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়।
এদিকে তীব্র গরম থেকে বাঁচতে বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো হলো রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ করে দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত রোদে যাওয়া যাবে না। জরুরি কাজে বাইরে যেতে হলে ছাতা ব্যবহার করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছায়াযুক্ত স্থানে বিশ্রাম নিতে হবে। সম্ভব হলে মাঝে মাঝে চোখে–মুখে পানির ঝাপটা দিতে হবে। হালকা রঙের সুতির ঢিলেঢালা পোশাক পরিধানের কথাও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত রোদের মাঝে বেশি সময় ধরে শারীরিক পরিশ্রমী কাজ ও খেলাধুলা থেকে বিরত থাকতে হবে। সহজে হজম হয় এমন খাবার খাওয়া, অসুস্থ বোধ করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা, তাপপ্রবাহ চলাকালীন শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, শ্রমজীবী ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রতি লক্ষ্য রাখারও পরামর্শ দেন তারা।