চট্টগ্রামে মোগল বিজয়ের স্মারক : আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ

ড. সেলিম জাহাঙ্গীর | সোমবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে মোগল বিজয়ের স্মারক : আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ’ নামকরণের মধ্যে এর ইতিহাসঐতিহ্য ধারণ করে আছে। দিল্লীর সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে তদীয় ভাই শাহ সুজার হত্যাকান্ড, আরাকানের মগ আর পর্তুগীজ জল দস্যুদের কবল থেকে চট্টগ্রামের মুসলমানদের স্থায়ী মুক্তির লক্ষ্যে সামরিক অভিযান আর এই মসজিদের ইতিহাস এক মোহনায় এসে মিলিত।

১৬৬৬ সাল। মোগল বাহিনীর চট্টগ্রাম দখল, চট্টগ্রামের নতুন নামকরণ ‘ইসলামাবাদ’, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ নির্মাণ, হাজার মাইল দূরত্বের দিল্লীর সাথে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি, হযরত বদর শাহের পবিত্র স্মৃতিধন্য চাটিগাঁ তথা ‘ইসলামাবাদ এর যে আত্মিক সংযোগ তা যে কী গভীর মাত্রায় উপনীত হয়েছিল ঐ সময়কালের একটি চিঠিতে এই তথ্য উঠে এসেছে ঐতিহাসিক অবিনশ্বর দলিল হিসেবে।

চট্টগ্রামের নতুন নামকরণ, নতুন মসজিদ নির্মাণের পর দিল্লীর সম্রাটের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের রাজস্বের উৎস জানতে চাইলে বিজয়ী বীর শায়েস্তা খাঁ অতি সংক্ষেপে সুগভীর তাৎপর্যপূর্ণ যে উত্তর দিয়েছিলেন তাতে ঐ সময়কালের চিত্রটি ফুটে উঠেছে সুন্দরভাবে

আসল কথা হল, মূল লাভ হল এ ভূখণ্ডে মুসলমানদের বিস্তৃতি লাভ। এর নগদ আয় হচ্ছে বাদশাহীর স্থায়িত্বের জন্য প্রজাদের দোয়া। মগ পর্তুগীজ উপদ্রব থামল, এখন বাংলার আবাদ শীঘ্রই বৃদ্ধি পাইবে। এতেই চট্টগ্রাম জয়ে কি লাভ বুঝতে পারবেন। (পৃ. ৫২)

বলাবাহুল্য, ১৬৬৬ থেকে আজ ২০২৫ সুদীর্ঘ এই প্রায় ৪০০ বছর সময়কাল ধরে এই ঐতিহাসিক বিজয়ের সুফল কীভাবে ভোগ করে চলেছে, পরম কৃতজ্ঞতার শোকরিয়া আদায় করে চলেছে তার অনুপূর্বিক দলিল হিসেবেই রচিত হয়েছে এই গবেষণাগ্রন্থ। পিএইচডিউত্তর এক প্রাতিষ্ঠানিক গবেষকের পরম যত্নকৃত শ্রম নিষ্ঠার সোনালী ফসল এই গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে।

সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বের প্রামাণ্য ইতিহাস বড় বেশি না থাকলেও সিপাহী বিদ্রোহের সাথে এই মসজিদের সম্পর্ক ৩ জন শহীদের দাফন, খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খাঁ কর্তৃক ইংরেজদের হাত থেকে এই মসজিদ পুনরুদ্ধার এরও নেপথ্যের দলিল তদীয় পীর বালাকোট যুদ্ধের সিপাহশালার সুফী নূর মোহাম্মদের আধ্যাত্মিক সংশ্লিষ্ট অনেক অজানা তথ্য উঠে এসেছে গভীরতর গবেষণায় (পৃ. ৫৮৬২)

এই সমাজের ইতিহাসঐতিহ্যের সাথে আরো জড়িয়ে আছে প্যালেস্টাইন যুদ্ধ, আবদুল হামিদ বোগদাদীর কথা, যিনি এই মসজিদের খতিব ছিলেন বৃটিশ শাসনামলে (পৃ. ৭৫)

মুসলিম জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে মসজিদের পক্ষ থেকে রাজকীয় সংবর্ধনা, ‘কবি সম্রাট’ উপাধী ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট অনেক বর্ণনা উঠে এসেছে কালানুক্রমিক বর্ণনায়।

বংশানুক্রমে মুরব্বীদের কাছ থেকে শুনে আসছি এই মসজিদের ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, সামাজিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা। বরকতময় এই মসজিদে জুমার নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে দূরদূরান্ত থেকে (ফেনী নদী থেকে নাফ নদী) ‘মোচাভাতি’ নিয়ে সাতসকালে রওয়ানা দিতেন ধর্মপ্রাণ শত শত মুরব্বী। বহুলাংশে পায়ে হেটে। বলাবাহুল্য, শত শত বছরের এই ঐতিহ্যিক আবহ আজও বহুলাংশে দৃশ্যমান। আজও আখেরী জুমাতে লাখো মুসল্লি সমাগম সেই ধারারই প্রতিফলন। রমজানের শেষ দশদিন এ মসজিদে ‘এতেকাফ’ না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া, ফিতরার ফয়সালায় এ মসজিদ ছিল বিতর্কহীন বিশ্বস্ততার প্রতীক।

এক কথায়, ইতিহাস, ঐতিহ্য, চট্টগ্রামের সমাজজীবন, ধর্মীয় আধ্যাত্মিক জীবন প্রবাহের চলমান প্রতীক আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। পঞ্চদশ অধ্যায়ে বিভক্ত ৪০০ পৃষ্ঠা বর্ণনায় এর চুম্বকসার বর্ণনা উঠে এসেছে রীতিমতো দৃশ্যকাব্যের মতো

মুসলিম বিজয়ের প্রেক্ষাপট, চট্টগ্রামের নতুন নামকরণ, মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস, ঐতিহাসিকদের বর্ণনা (পৃ. ১৭৬২)

খতিব ও পেশ ইমামদের জীবনী ও দায়িত্ব পালনের সময়কাল (পৃ. ৬৬১৪৩)

মসজিদ কমিটি সেক্রেটারীদের জীবনী, দায়িত্ব পালনের ইতিহাস

ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে নেওয়ার প্রেক্ষাপট, দলিলপত্র হস্তান্তর, প্রসঙ্গ

প্রাচীনতম মসজিদ ঐতিহাসিক শিহাবউদ্দীন তালিশ থেকে ড. আবদুল করিম পর্যন্ত গবেষকদের তথ্যে ১৫টি মসজিদের দীর্ঘ ইতিহাস (পৃ. ২৪২২৫০)

শিলালিপির বর্ণনাসহ শহর চট্টগ্রামের মসজিদ পরিসংখ্যান/আন্দরকিল্লা সহ সাতটি মসজিদের দীর্ঘ বর্ণনা (পৃ. ২৫০২৬৪)

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জরীপে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মসজিদের পরিসংখ্যান। চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার হিসেবে সীতাকুণ্ডের গুরুত্ব বিবেচনায় (নমুনা হিসেবে) এর ১০টি ইউনিয়নের ২৭১টি মসজিদের বর্ণনা যে মসজিদ সংস্কৃতি গবেষণায় উৎসাহ যোগাবে গবেষকমহলকে।

মসজিদের খেদমতে স্থানীয় মহল্লাবাসী (২৭৫২৮৩) চট্টগ্রামের সমাজজীবনের সবিশেষ উল্লেখযোগ্য সাত ব্যক্তিত্বদের সুগভীর সম্পর্কের বিস্তারিত এই গ্রন্থকে দান করেছে আরেক ঐতিহাসিক মর্যাদা, যার রেশ আজও দৃশ্যমান।

এর পাশাপাশি ২০ জন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যাঁরা মসজিদের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছেন আজও (পৃ. ২৮৬৩০৯) যেমন : মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, হাতি কোম্পানী, দোভাষ পরিবার, একে খান, নূর আহমদ চেয়ারম্যান, দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল খালেক।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহকালে সশস্ত্র সিপাহীদের বিশ্বস্ত গোপন আস্তানা গড়ে উঠেছিল এ মসজিদেই। তিন জন শহীদের স্মৃতি সেই ইতিহাস বুকে ধারণ করে আছে আজও।

কাজী নজরুলকে কবি ‘সম্রাট উপাধি’ এ মসজিদের আর এক ঐতিহাসিক তাৎপর্যবহ স্মৃতিজাগানিয়া ঐতিহ্য। বিস্ময়ে অভিভূত নজরুলের অকল্পনীয় অবিশ্বাস্য প্রতিক্রিয়ায় এই মসজিদ কেন্দ্রিক চট্টগ্রামকে ‘আরাফাতে’র মর্যাদার অবলোকনের অভিভাষণ আজও আমাদের শিহরিত রোমাঞ্চিত করে। ঐশী প্রেরণায় প্রণোদনা জোগায় সেই গুরুভার বহনের কর্তব্য সম্পাদনের অগ্রযাত্রায়। যেমন : চট্টগ্রামের জাগতিক, আধ্যাত্মিক ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে কাজী নজরুল মন্তব্য করেছিলেন

) আমায় সাদর সম্ভাষণ করেছে তোমাদেরই তোমাদেরি গিরিসিন্ধুনদীকান্তার পরিশোভিত পরীস্থান-(নজরুল রচনাবলী, বা, , ঢাকা, ১৯৯৬, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ১০০০)

) সাগর যাদের চরণ ধোয়ায়, পর্বতমালা যাদের শিয়রের বিনিদ্র প্রহরী, নদীনির্ঝরিনী যাদের সেবিকা, অগ্নিগীরী যাদের বুকের উপর, উচ্ছল জলপ্রপাত যাদের অবিনাশী প্রাণধারা, কাননকুঞ্জ যাদের শ্রীনিকেতন, বন্যহিংস্র শার্দূলসর্প যাদের নিত্য সহচর, তারা সেই মহান পুরুষের বিরাট দায়িত্বকে গ্রহণ করতে ভয় করে এ কথা আর যে বলে বলুক, আমি বলব না (, পৃ. ১০৩)

) আপনাদের ইসলামাবাদ হোক ওরিয়েন্টাল কালচারের পীঠস্থানআরাফাত ময়দান। দেশবিদেশের তীর্থযাত্রী এসে এখানে ভীড় করুক। আজ নব জাগ্রত বিশ্বের কাছে বহু ঋণী আমরা, সেই ঋণ আজ শোধই করব নাঋণ দানও করব; আমরা আমাদের দানে জগতকে ঋণী করবেএই হোক আপনাদের চরম সাধনা। হাতের তালু আমাদের শূন্যপানেই তুলে ধরেছি এতদিন, সেই লজ্জা আজ আমরা পরিশোধ করব। আজ আমাদের হাত উপুড় করবার দিন এসেছে। তা যদি না পারি সমুদ্র বেশি দূরে নয়, আমাদের এ লজ্জার পরিসমাপ্তি যেন তারি অতল জলে হয়ে যায় চিরদিনের তরে। আমি বলি, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মত আমাদেরও কালচারের সভ্যতার জ্ঞানের সেন্টার বা কেন্দ্রভূমির ভিত্তি স্থাপনের মহৎভার আপনারা গ্রহণ করুনআমাদের শত শত তরুণ খাদেম তাদের সকল শক্তি আশাআকাঙ্ক্ষা জীবন অঞ্জলির মত করে আপনাদেরসে উদ্যমের পায়ে অর্ঘ্য দেবে। (, পৃ. ১০৪)

) প্রকৃতির এই লীলাভূমি সত্যি সত্যিই বুলবুলিস্থানে পরিণত হোকইরানের শিরাজের মত। শত শত সাদি, হাফিজ, খৈয়াম, রুমী, শমশিতবরেজ এই সিরাজবাগেএই বুলবুলিস্থানে জন্মগ্রহণ করুক। সেই দাওয়াতের আমন্ত্রণের গুরুভার আপনারা গ্রহণ করুন। আপনারা রুদকির মত আপনাদের বদ্ধ প্রাণধারাকে মুক্তি দিন (, পৃ. ১০৪)

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইউক্রেনের প্রধান সরকারি ভবনে আগুন
পরবর্তী নিবন্ধহুলাইনের ৪০০ বছরের পুরনো ‘মুছা খাঁ জামে মসজিদ’