চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলীস্থ পোর্ট লিংক রোডের পাশে ৩০ একর সরকারি জমির উপর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও যাদুঘর নির্মাণের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের পর এটি হবে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্মৃতিসৌধ। এর মধ্যদিয়ে চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের ইচ্ছা, স্বপ্ন ও আকা[ঙ্ক্ষা পূর্ণ হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জাম্মেল হক।
মন্ত্রী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও যাদুঘর নির্মাণ করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য যে জায়গা বাছাই করা হয়েছে, তা অত্যন্ত চমৎকার একটি জায়গা। এত সুন্দর স্থান দেখে আমি অভিভূত। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এলাকাটি স্বর্ণের খনিতে রূপান্তর হবে। এ অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়বে। ব্যাপক উন্নয়ন হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতো গুরুত্ব পাবে। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় নগরীর উত্তর কাট্টলীস্থ পোর্ট লিংক রোডের পাশের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও যাদুঘর নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত স্থান পরিদর্শন উপলক্ষে জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আ ক ম মোজ্জাম্মেল হক বলেন, ঢাকার পরে মুক্তিযুদ্ধের সুঁতিকাগার চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক জায়গাগুলো সংরক্ষণ করবো, যাতে তারা ইতিহাস বিকৃত করতে না পারে। এখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মহাপরিকল্পনা চলছে। একমাস পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব জায়গা দেখে গেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছেন। বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবাসেন বলে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে এ বিষয়টিতে সম্মতি দিয়েছেন। এ নিয়ে ইতোমধ্যে আমাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা বলেছেন। বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছে। আমরা শিগগিরই এটি করবো। এ জমিগুলো প্রতীকী মূল্যে আমাদের মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত করা হলে আমরা সেটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবো ও দ্রুততার সাথে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আপনাদের যে পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণ করবো আমরা। পরবর্তীতে যেন মানুষের সামনে তা উপস্থাপন করা যায় সে ব্যবস্থা করবো। এখানে বড়পরিসরে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্যও নির্মাণ করা হবে। চট্টগ্রামবাসীর ইচ্ছা, স্বপ্ন, আকাঙ্খা আমরা যাতে পূর্ণ করতে পারি সেজন্য আপনারা দোয়া করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করবেন। যাতে এ দেশ আরও এগিয়ে যেতে পারে।
মন্ত্রী আরো বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকার পরে চট্টগ্রামের স্থান ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রামকে আগলে রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এই চট্টগ্রাম থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে এম এ হান্নান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। জননেতা এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মহিউদ্দিন চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সহ অনেক বড় নেতা চট্টগ্রামের। তাই বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের কথা সবসময় বলতেন এবং চট্টগ্রামকে ভালোবাসতেন। বর্তমানেও বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিশেষ গুরুত্ব দেন এ চট্টগ্রামকে।
মন্ত্রী বলেন, ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শেখ মুজিব নগর আন্তর্জাতিক মানে সংরক্ষণের কাজ চলছে। কিন্তু যেখান থেকে মানুষ স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে পেয়েছিল, সেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের বিষয়ে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক স্মৃতি বিজড়িত স্থান রয়েছে, সেগুলো এখনো সংরক্ষণ হয়নি। জিয়াউর রহমানেরা ইতিহাস বিকৃত করতে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। কুচক্রী মহল যাতে ইতিহাসকে বিকৃত করতে না পারে, সেজন্য এ স্থানগুলো সংরক্ষণ করতে হবে।
সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজ্জাম্মেল হক এমপি বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীসহ অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এমএ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত এ মহান স্বাধীনতা। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও যাদুঘর নির্মাণ করা হবে।
জায়গাটি পরিদর্শন শেষে প্রজেক্টরের মাধ্যমে জায়গাটির বিস্তারিত বর্ণনা দেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নাজমুল আহসান। তিনি বলেন, জায়গাটি উত্তর কাট্টলী মৌজা। চারটি অবৈধ ইট-ভাটা ছিল এখানে। জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ করার পর আবারও দখল করে তারা। এরপর আমরা পুণরায় সমূলে উচ্ছেদ করি। মূখ্য সচিব মহোদয় পরিদর্শন করেছেন। পরে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করেন। এতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি জানিয়েছেন। ৩০ একর সরকারি খতিয়ানভুক্ত জায়গা।
নাজমুল আহসান বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি শ্মশান রয়েছে, সেটি আমরা ঠিক রাখবো। এর কোনো ক্ষতি হবে না। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের পর এটি হবে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্মৃতিসৌধ।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক নৌ পরিবহণ মন্ত্রী শাহজান খান বলেন, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যা করার দরকার প্রধানমন্ত্রী তা-ই করে দিয়েছেন। আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অতন্দ্র প্রহরী। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু এখনো পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা ধর্মের নামে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। হিন্দু সমপ্রদায়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কুরআন রেখে তারা দেশে অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছে।
তিনি আরও বলেন, উগ্র সামপ্রদায়িকতাকে রুখতে হবে। জাতির প্রয়োজনে আবারও আমরা রাস্তায় নামবো। স্বাধীনতা বিরোধীদের কঠোর হস্তে দমন করবো।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের সভাপতিত্বে ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ নাজমুল আহসানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এমপি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য নাহিদ ইজহার খান এমপি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ফরিদা খানম সাকী এমপি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের এমডি এম. ইদ্রিস সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমেদ ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার একেএম সরওয়ার কামাল দুলু। অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাগণ, সর্বস্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। দুপুর ২টায় চট্টগ্রাম নগরীতে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন শেষে বিকেল সাড়ে তিনটায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজ্জাম্মেল হক এমপি।